চিলির গণমানুষের শিল্পী ভিক্টোর জারা ——– তাহা ইয়াসিন

১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকে চিলির জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী ছিলেন ভিক্টর জারা। তিনি চিলির ক্ষমতাসীন অভিজাতদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গান লিখতেন এবং বামপন্থি প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের সমর্থক ছিলেন। গানের মাধ্যমে তিনি মানুষের হ্রদয়ে স্থান করে নেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলেন।

ভিক্টোর জারা ১৯৩২ সালে চিলির সান্তিয়াগো শহরের কাছে লনকেন-এ এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর মা-বাবা দুজনেই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিলেন । অনেকে বলেছেন তাঁর বাবা কৃষিখামারে চাকরি করতেন। চাকরি কিংবা সরাসরি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থাকুন তাঁর সেই আয়ে সংসারে অস্বচ্ছলতা ছিল। তাই তাঁর পিতা নানাকাজেই ছেলেকেও সাথে নিয়ে যেতেন। কিন্তু মা চাইতেন তার সন্তানেরা ভালো শিক্ষা পাক। তাঁর মা কৃষি কাজ ছাড়াও পিয়ানো, গিটার বাজানোতে পারদর্শী ছিলেন। গ্রামের বিভিন্ন বিয়ে, অনুষ্ঠান বা শেষকৃত্যে গান করতেন তিনি। মূলত পারদর্শী ছিলেন চিলির লোক সঙ্গীতে।

সেকারণে শৈশব থেকে মায়ের কাছে লোকসঙ্গীত শিখতেন ভিক্টর জারা। অসাধারণ কন্ঠের অধিকারী ভিক্টর ছোটবেলা থেকেই লোকসঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন । অল্পবয়স থেকে তাঁকে আয়ের সাথে যুক্ত হতে হয়, মাকে হারান পনের বছর বয়সে। এই টানাপোড়েনের জীবনে কিছুকাল হিসাব রক্ষণের কাজ শেখার পর ভর্তি হন এক সেমিনারিতে। সেমিনারিতে থেকে পরে চাকরি নেন চিলির সেনাবাহিনীতে। কিন্তু সেখান মন টেকেনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের সঙ্গীতের টানে ফিরে আসেন গ্রামে। নিজ গ্রামে সঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে যান তিনি। ১৯৬০ এর দশকে তিনি সান্তিয়াগো শহরে একটি গানের দলের সাথে যুক্ত হয়ে লোক সঙ্গীতে বিশেষ মনোনিবেশ করেন। ক্রমে সেখান থেকে তিনি যুক্ত হয়ে পরেন ল্যাতিন আমেরিকার লোক সঙ্গীত আন্দোলনে। সেই সময়েই ভিক্টর জারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা ভ্রমণ করেন। ফিরে এসে তিনি চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ‘৭০-এ চিলির নির্বাচনে ড.সালভেদর আলেন্দের পক্ষে গান গেয়ে প্রচারণায় অংশ নেন এবং আলেন্দে জয়লাভ করেন।

১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে হত্যার করে চিলির ক্ষমতা দখল করে জেনারেল আগুস্তো পিনোশে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরশাসক পিনোশের ১৭ বছরের শাসনামলে চিলিতে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত অথবা নিখোঁজ হয়।

সামরিক অভ্যুত্থানের পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর ভিক্টোর জারাকে গ্রেফতার করা হয়। জেনারেল পিনোশের সমর্থক সেনারা চিলির স্টেডিয়ামে আরো পাঁচ হাজার প্রগতিশীল সহযোদ্ধার সাথে তাঁকেও বন্দী করে নির্মম নির্যাতন চালায়। ভিক্টোর জারা সেসময় পেশাগতভাবে ছিলেন সান্তিয়াগোর কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়াও ছিলেন চিলিতে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্টার কারিগরদের অন্যতম। সালভেদর আলেন্দের নেতৃত্বে যে ‘ পপুলার ইউনিটি ‘ নামের বামমোর্চা গঠিত হয় তার অন্যতম সংগঠকও ছিলেন জারা। তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গণসঙ্গীত ” ভেনসারেমস ” – আমাদের হবেই জয় ছিল সে বাম মোর্চার ‘ এনথেম ‘।

জারাকে লে.কর্নেল পেড্রো পাবলো বারিয়েন্টোসের নির্দেশে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। কয়েকদিন উপোস রেখে যাদেরকে গান গেয়ে শক্তি জুগিয়েছেন সেই কয়েদীদের সামনে জারার উপর চালানো হয় নির্যাতন। আহত, ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় তিনি গান ধরেন ‘ ভেনসারেমস’ বামমোর্চার জাতীয় সংগীত। 
বন্দী অবস্থায় তিনি ‘এস্তাদিও চিলে’ বা চিলি স্টেডিয়াম ‘ নামে একটি অসাধারণ কবিতা রচনা করে বন্দী সহযোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে গাইতে থাকেন। সৈন্যরা তাঁকে গান থামাতে বললেও তিনি গান চালিয়ে যান। এরপর রাইফেলের বাটের আঘাতে আঘাতে তাঁর দুহাত দুমড়ে মুসড়ে থেঁতলে দেয়ার পর চল্লিশটি গুলি চালিয়ে ঝাঁঝড়া করা হয় তাঁর দেহ। তাঁর ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহটি সান্তিয়াগোর এক শহরতলীর রাস্তায় ফেলে রাখা হয় মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য । তারপর সেই লাশ ফেলা হয় অন্য হাজারো মৃত কয়েদীদের লাশের মাঝে। সেখান থেকে জারার স্ত্রী তাঁর লাশ সনাক্ত করেন। মৃত জারা যে জীবিত জারার চেয়েও শক্তিশালী সেটা বুঝতে সামরিকজান্তাদের অসুবিধা হয়নি আর সেকারণে লাশ নিয়ে এই লুকোচুরি।

জারার দেহের চেয়েও সামরিক জান্তার কাছে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী তাঁর গান। যে গান শত শত বুলেট বেয়নোটের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে চিলিকে জাগিয়ে তুলতে পারে, সামরিক স্বৈরশাসকের ক্ষমতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে তাই তারা এর পর আক্রোমন করে তাঁর গানের উপর। পারলে মানুষের কন্ঠ থেকে, মানুষের স্মৃতি থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মুছে ফেলে তাঁর গানের কথা, সুর ও চেতনাকে। সেকারণে যেখানেই পেয়েছে সেখান থেকেই তাঁর অধিকাংশ সংগীতের মূল রেকর্ড পান্ডুলিপি ধবংস করে ফেলে তারা । অস্ত্র দিয়ে শাসকগোষ্ঠী মানুষের হ্রদয় থেকে ন্যায়ের চেতনাকে কখনোই মুছে ফেলতে পারেনি। সেকারণে ভিক্টোর জারার গানকে মানুষের হ্রদয় থেকে নিঃশেষ করাও সম্ভব হয়নি ; আজো চিলির সমুদ্র-সৈকতে কিংবা কোনো নিভৃত পল্লীতে মানুষ ভিক্টোর জারার কোনো গান বিড়বিড় করে উচ্চারণের মাধ্যমে জেগে ওঠে ন্যায়ের শক্তিতে। 
সান্তিয়াগোতে রয়েছে ভিক্টোর জারার কবর, যেখানে লেখা ‘বিজয় পর্যন্ত ‘। সে কবর বিজয়ের জন্যই আজো শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে।

২০০৯ সালে জারার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরীক্ষা করা হয়। চিলির হাজারো মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর পর তাকে পুনরায় সমাহিত করা হয়।
চিলির সাবেক সেই সেনা কর্মকর্তা পেড্রো পাবলো ব্যারিয়েন্টোসকেই জারার হত্যার জন্য দায়ী করা হয়। অরল্যান্ডোর নাগরিক আদালতের বিচারক জারার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়। ( সূত্র:২৮ জুন ২০১৬ বিডিনিউজ২৪.কম) উক্তসূত্র থেকে আরো জানা যায় ব্যারিয়েন্টোস বর্তমানে ফ্লোরিডায় বসবাস করছেন। ফ্লোরিডার আদালতেও জারার স্ত্রী জোয়ান এবং মেয়ে আমান্ডা সাবেক ওই সেনাঅফিসার ব্যারিয়েন্টোসের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

https://worldbeyondwar.org  এই ওয়েবসাইটেও জারার পরিবারের পক্ষ থেকে ফ্লোরিডার আদালতে মামলার কথা বলা হয়েছে ,

In Florida, a jury has found former Chilean army officer Pedro Barrientos liable for the murder of legendary folk singer and activist Víctor Jara in September 1973. In the days after dictator Augusto Pinochet seized power in a U.S.-backed coup, Víctor Jara was rounded up, tortured and shot more than 40 times. Barrientos has lived in the United States for more than two decades and is now a U.S. citizen. The Jaras sued him under a federal civil statute known as the Torture Victims Protection Act, which allows U.S. courts to hear about human rights abuses committed abroad. The Guardian newspaper called the verdict “one of the biggest and most significant legal human rights victories against a foreign war criminal in a US courtroom.” We speak to Víctor Jara’s widow Joan, his daughter Manuela Bunster and Dixon Osburn, executive director of the Center for Justice and Accountability, which represented the Jara family.

এই বিচার-প্রক্রিয়া যুগে যুগে গণমানুষের হ্রদয়েও চলতে থাকবে। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীসে সক্রেটিসকে পাঁচ শতাধিক বিচারকের জুড়ি বসিয়ে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেই দেশের আদালতই এতদিন পরে হলেও সেটাকে অন্যায় বলেই রায় দিয়েছে । আমেরিকা পল রবসনকেও মামলা নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে হেনস্থা করার চেষ্টা করে এবং রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় একদিন হত্যাও করে । কালে কালে দেশে দেশে ভিক্টোর জারা সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে কখনো গ্রীসে কখনো আমেরিকায়, কখনো ভারতবর্ষে মুকুন্দ দাস হয়ে জন্মায়। ন্যায়ের স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত করে গুলিতে ঝাঝরা হয়ে, কখনো, বিষ প্রয়োগে, প্রাণ হারাণ কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের সেই আলো রেখে যান নতুন আরেকজনের জন্মের প্রতীক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *