ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ছেলে মুর্তজা বশীর

তাহা ইয়াসিন

বিখ্যাত মানুষের সন্তানরা খুব কমই বিখ্যাত হন। মুর্তজা বশীর সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ঢাকা শহরে অনেক বিখ্যাত লোকের ছেলেমেয়ে আছেন। এখন বিখ্যাত লোক পাড়া-মহল্লায় হওয়ায় তার সংখ্যা আরো বেশি। আরো ব্যাপার আছে। বিখ্যাত লোকেরা ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি রেখে না গেলেও ছেলেমেয়েরা তেমন কিছু করেন না। অনেকে অনেকের নাম বলতে পারবেন যাদের ছেলেমেয়েরা সম্পত্তি ভোগ করে এবং সেটারই ভাড়া শোধের জন্য বছরে টছরে এটাওটা করে। কেউ কেউ আছেন যারা পিতার কথা বেমালুম ভুলতেই পছন্দ করেন। কেউ কেউ আছেন বিদেশে, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির ফ্রেন্ড সার্কেলে পিতা কী ছিলেন তা বলার সুযোগ পান না। আর অনেক ক্ষেত্রে বলে লাভও হয় না। আমার জানামতে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ছেলেমেয়ে ফরাসি মায়ের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ওয়ালিউল্লাহ সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত। এরকম ব্যতিক্রম আছে। আবার এমনও আছে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের ছেলেমেয়েরা একেকজন একেক দেশে থাকার কারণে এবং সম্পত্তি ভাগাভাগির জটিলতায় পিতার বই-পুস্তক অবহেলায়, অনাদরে যে যার মত ছেপে খায়। মুর্তজা বশীরও ছোটবেলা থেকে নিজের মত বেড়ে ওঠায় পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র বিরাগভাজন হয়েছিলেন নানা সময়। কিন্তু তাঁর প্রবল ইচ্ছা ছিল তিনি বিখ্যাত হবেন। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ছেলে তিনি এই অহমিকা স্কুলজীবনেই ভেঙে ফেলেন।

চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর ১৫ আগস্ট ২০২০ সালে মারা যান। তিনি অনেকদিন ধরে হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। তিনি ১৯৩৯ সালে সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন নবকুমার হাই স্কুলে । এখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন । তারপর পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করার পর বগুড়া আযিযুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। পরিবারও তাঁর সাথেই বগুড়ায় অবস্থান করে। সেই সূত্রে মুর্তজা বশীর ১৯৪৯ সালে বগুড়া থেকে মেট্টিক পাশ করেন। এরপরই যুক্ত হন কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে। সেসময়ের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন বগুড়া এলে তাঁর সাথে দেখা হয় এবং তিনি মুর্তজা বশীরের অটোগ্রাফের খাতায় যে বাক্যটি লিখেছিলেন সেটি তাঁর হৃদয়ে গেঁথে যায়। ‘ আমার ছেলেবেলা ‘ নামক এক লেখায় মুর্তজা বশীর সে কথা লিখেছেন,’ দেশভাগের পরপর বগুড়ায় এসেছিলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন। তিনি পার্টি অফিসে আমার আঁকা প্রতিকৃতিগুলো দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে খবর পাঠান। আমি আগেই বলেছি, শিল্পী হওয়ার কোনো বাসনা আমার ছিল না। তবু এসব মহান নেতার প্রতিকৃতি আঁকার এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষা মনে জন্মেছিল। তাই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম কীভাবে বড় সাইনবোর্ডে খোপ কেটে কেটে ছোট্ট ছবি বিশলাকায় আঁকা হতো। বাসায় এসে আমি সেভাবে অনুশীলন করতাম। পরে যখন কিছুটা রপ্ত হয় তখন প্রতিকৃতিগুলো আঁকি। ভবানী সেন আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখেছিলেন : ‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভিতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।’ কথাগুলো আমার মনে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। পরবর্তীকালে আমার শিল্পীজীবনে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই শিল্পকর্মগুলো সৃষ্টি হয়েছে।

‘বগুড়ায় কয়েক বছর থাকার পর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সুপারনিউমারি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ফলে তাঁর পরিবারও ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় ফেরার পর কমিউনিস্ট পাটির সাথে মুর্তজা বশীরের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বড় ভাই তকীয়্যুল্লার মাধ্যমে। তাঁর বড় ভাই ছিলেন সেসময় আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা। তাঁর আগেই নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালেই মুর্তজা বশীর ছাত্র ফেডারেশনের কর্মি ছিলেন। পার্টির নির্দেশে পরে তিনি ভর্তি হন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজে (বর্তমানের চারুকলা ইন্সটিটিউটে)। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে আর্ট কলেজ চালু করার পর ১৯৪৮ সালে ভর্তি হয় ১ম ব্যাচ। দ্বিতীয় ব্যাচ যথারীতি শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। এই দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন মুর্তজা বশীর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ও স্নেহে গড়ে ওঠে তাঁর শিল্পীজীবন। পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ চারুকলায় ভর্তি হওয়াটা সহজে মেনে নিতে চাননি কারণ তিনি প্যারিসে দেখেছেন শিল্পীদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের এবং অনিশ্চয়তায় ভরপুর। সেটি নিজের ছেলের জীবনে দেখতে চাননি। উল্লেখ্য যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ প্যারিসে পিএইচডি করেছেন, Buddhist Mystic Song বিষয়ে। ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিস থেকে ফেরার সময় ল্যুভর মিউজিয়ামের চিত্রগুলোর রঙিন ছবির দুই খণ্ড অ্যালবাম সাথে এনেছিলেন। আর্ট কলেজে ভর্তির পর তিনি সেগুলো মুর্তজা বশীরকে দিয়ে দেন। স্বদেশের বিদ্যালাভ শেষে ইতালির ফ্লোরেন্সে ও ফ্রান্সের প্যারিসের দুটি বিখ্যাত চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুর্তজা বশীর শিক্ষা ও দীক্ষা লাভ করেন। তিনি স্কলারশিপে পড়তে যাননি ফলে বিদেশে লেখাপড়া খরচ নিয়মিতই দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। দেশে ফিরে তিনি শুরু করেন নিরীক্ষাধর্মী শিল্পচর্চা। প্রত্যক্ষভাবে মেহনতি মানুষের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় মুর্তজা বশীর তাদের জীবনের গভীরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। সেকারণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর শিল্পকলায় প্রভাব ফেলেছে। তিনি চিত্রকলায় অনুশীলন করেন প্রান্তিক মানুষের কষ্ট-জর্জরিত জীবন ।

মুর্তজা বশীর

শ্রমী মানুষের জীবনের চিত্ররচনার অঙ্গীকার তাতিয়ে উঠে ৫২-র ভাষা আন্দোলনে। মিছিলে ছিলেন বিদ্যার্থী শিল্পী মুর্তজা বশীরও। গুলিবিদ্ধ বরকতকে হাসপাতালে নেয়ার সময় রক্তে লাল-ছোপ লেগে যায় জামায়। সেই অবস্থায় বাসায় ফিরে আসলে পিতা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ খুশি হন এবং নিজের আচকান কেটে পুত্রকে কালো ব্যাজ পরিয়ে ভাষা-যোদ্ধা হিসেবে অভিনন্দিত করেন। মুর্তজা বশীর ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ সম্বলিত প্লাকার্ড উত্তোলিত মিছিলের মানুষের ছবি এঁকে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম ছাপচিত্র যুক্ত করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ছবি প্রথম কাগজে কালিতে আঁকলেও পরে তা কাঠখোদাইয়ে আঁকেন। কাঠ খোদাইয়ের এই ছাপচিত্র অনেক সংস্করণ হয়ে অনেক সংগ্রামী মানুষের চেতনাকে আরও প্রাণিত করে । ছাপচিত্রই যে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক মাধ্যম সেটার অনুশীলন তাঁর মাধ্যমেই বিকশিত হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও ১৯৪৯ সালের চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবমন্ত্র চিত্ররূপ লাভ করে ছাপচিত্রের মাধ্যমেই। তারুণ্যদীপ্ত দিনগুলোতে সাম্যবাদী রাজনীতিতে মুর্তজা বশীর যে দীক্ষা লাভ করেছিলেন তা-ই তাঁকে ৫২-র মিছিলে অংশ নেয়ায় অনুপ্রাণিত করে। তাঁর তুলি থেকে রং নয়, মানুষের দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসে।একজন বোদ্ধা চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি পরবর্তীতে সেকারণেই অনায়াসে মানুষের হৃদয়ে আসন লাভ করেন। তাঁর চিত্রকলায় মানুষের জীবনই মূর্ত হয়ে ওঠে । দীর্ঘজীবনে তিনি নিজের সবটুকু আন্তরিকতা দিয়ে এঁকে গেছেন। বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিসরে তিনি ছিলেন অপরিহার্য এবং উল্লেখ্য এক নাম। নামকরা আঁকিয়েদের সারিতে তাঁর নাম আছে। তিনি কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশে বিমূর্ত ধারার চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। তাঁর আঁকা ‘দেয়াল’ ‘ শহীদ শিরোনাম ‘, ‘ পাখা’ ‘ রক্তাক্ত ২১ ‘, ,সিরিজ ‘ এপিটাফ ফর মাটিয়ার্স ‘ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য । পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্র এবং দেয়ালচিত্র করেছেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। তাঁর লেখা গল্প,উপন্যাস, কবিতা, আত্মজীবনী, শিল্পসমালোচনা রয়েছে। গবেষণা করেছেন মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়েও। ১৯৪৭ এর পর এই অঞ্চলের শিল্পকলার বিকাশে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ্যযোগ্য। তাঁর একটি বক্তব্য, ‘ জীবনের ধাপে ধাপে নানাজনের কাছ থেকে নানা শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করেছি। ১৯৬১ সালে লাহোরে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে বলেছিলাম, ফয়েজ ভাই, আমার নাম হয় না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, বশীর, তুমি নামের পিছনে ছুটো না, নাম তোমার পেছনে ছুটবে। এটাও আমার একটা শিক্ষা। ‘ (সাক্ষাতকার প্রথম আলো ২০১১ সালের ১২ আগস্ট) কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *