তাহসান-মিথিলার লাইভ: ব্যক্তিগত সম্পর্ক যখন পণ্য

মাধবী লতা

গেল শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন মিডিয়ার দুজন অতি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তাহসান খান ও রাফিয়াদ রশিদ মিথিলা। এক সময়ের এই তারকা দম্পতির পথ আজ দুদিকে বেঁকে গেছে। তাই, তাদের লাইভে আসা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা।

পরস্পর অনুরক্ত দুজন মানুষের একসাথে বাস করার সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের নাম বিয়ে। যে স্বপ্ন, সাধ আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দুটি মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, অনেকক্ষেত্রে তা পূরণ হয় না। শুরু হয় মতানৈক্য, বাড়ে দূরত্ব, একসময় তা গড়ায় বিচ্ছেদে। বিবাহবিচ্ছেদ কাম্য না হলেও তা বিবাহের মতোই একটি সাধারণ বিষয়। যদিও আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদকে এতটাই অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা হয় যে, চরম অসুখী অনেক দম্পতিই জীবনের সকল চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের কাছে তথাকথিত ভালো মানুষের তকমা বজায় রাখতে বিয়েটা টিকিয়ে রাখেন। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই সন্তান হয়ে ওঠে একটি বড় ফ্যাক্টর। কেননা, আমাদের সমাজে প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো সুসম্পর্ক দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা ধরেই নিয়েছি, বিচ্ছেদের পর প্রাক্তনের সাথে থাকতে হবে দা-কুমড়া সম্পর্ক। প্রাক্তনের মুখ দেখতে নেই, মঙ্গল কামনা করতে নেই, দেখা হলে পুরনো দিনের তিক্ত ঘটনা মনে করে বাক-বিতণ্ডাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। নিদেনপক্ষে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। প্রাক্তনের সাথে কোনো সন্তান থেকে থাকলে সেই সন্তানের লালনপালনের দায়িত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুস্থ স্বাভাবিক উপায়ে বন্টিত না হয়ে মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। তাই বিয়েটা যে কোনো মূল্যে অনেকেই টিকিয়ে রাখতে চান।

বিবাহবিচ্ছেদকে আমরা বিয়ের চাইতেও বেশি কঠিন করে ফেলেছি। দুজন মানুষের যেমন নিজের পছন্দে বিয়ে করার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে মতের মিল না হলে বিচ্ছেদের অধিকার। অথচ আমাদের অনধিকার চর্চায় অতিউৎসাহী সমাজ সেই অধিকারকে খর্ব করে পদে পদে। যুগল প্রেমে ফোটানো পদ্ম না দেখে আমরা পাঁক ঘেঁটে বড় সুখ পাই। বিচ্ছেদের পর প্রাক্তনের নামে কুৎসা রটানো, তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা এমনকি সন্তানের কাছে তাকে অকারণ খলচরিত্র হিসেবে উপস্থাপন- কিছুই বাদ পড়ে না। এহেন সমাজের অংশ হিসেবে তাহসান-মিথিলার একসাথে লাইভে আসা ও পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় রেখে কথা বলা আপাতদৃষ্টিতে অনুকরণীয় মনে হলেও বিষয়টি আদতে কী ঘটেছে তা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

ছবি : তাহসান ও মিথিলার লাইভ

তাহসান ও মিথিলার প্রণয় থেকে পরিণয়। এরপর বিচ্ছেদ। তাদের রয়েছে একটি কন্যাসন্তান। মিথিলা নতুন করে সংসার পেতেছেন। সন্তানটি রয়েছে তার সাথেই। তাহসান এখনো একাই। তাদের বিচ্ছেদের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেননি। দুজনেই শিষ্টাচার মেনে চলেছেন এত বছর। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে তারা হয়ে উঠেছেন রোল মডেল। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পাবলিক কমেন্টে সাধারণ মানুষ কদর্য ভাষায় মিথিলাকে আক্রমণ করতে ছাড়েনি। যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাহসান এই লাইভে এসে। তিনি মানুষকে এটাও বোঝাতে চেয়েছেন কীভাবে প্রাক্তনের সাথে একও টেবিলে বসে ভদ্রতা রক্ষা করে একে অপরকে সম্মান জানিয়ে কথা বলা যায়। তাহসান তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে এসে সারপ্রাইজের ঘোষণা দিয়েছিলেন। মিথিলাও তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে এসে সেই সারপ্রাইজের জন্য অপেক্ষার কথা জানিয়েছেন। তারা যতই সারপ্রাইজের কথা বলুন না কেন, এটি যে একটি কোম্পানির ব্যবসায়িক প্রচার ও প্রসারের জন্য আয়োজিত লাইভ তা বোঝার বাকি থাকে না। কারণ তাহসান ও মিথিলা দুজনেই এই কোম্পানির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এমনকি দর্শকদের সারপ্রাইজ গিফট দেওয়ার ঘোষণাও এই লাইভের ভিউ বাড়ানোর একটি চমৎকার কৌশল। তাহসান-মিথিলা বিচ্ছেদের পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানের যে জায়গাটা তৈরি করেছিলেন, যে উদাহরণ তৈরি করেছিলেন আমাদের এই অসহিষ্ণু সমাজে- তা এতকাল পরে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হলো।

তাহসান-মিথিলার সম্পর্ক বর্তমানে যেমনই হোক, হোক ঘৃণার কিংবা সম্মানের- তা কেবল একান্তভাবে তাদেরই। তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভক্তদের কৌতুহল থাকে। তারকাদের বুঝতে হবে, কতটা তিনি উন্মোচন করবেন। কেননা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটা মাধুর্য থাকে। একান্ত ব্যক্তিগত সবকিছুই খোলা ময়দানে প্রদর্শণযোগ্য নয়। তাতে কিছুটা আড়াল, কিছুটা আবডালই কাম্য। জীবনকে শিল্পসম্মতভাবে বাঁচতে গেলে এটুকু মার্জিত সীমারেখা টানা প্রয়োজন। তবে, তাহসান-মিথিলা যে ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছেন বলে দাবি করেছেন, ভক্তদেরসহ সাধারণ দর্শকদের কাছে যে বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছেন, তা তারা তাদের নিজস্ব ফেসবুক লাইভে এসেই করতে পারতেন। এর জন্য কোনো কোম্পানির স্পনসরশীপের প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল না নিজেদের সম্পর্কের রসায়নকে পন্য করে তোলার। মানুষের মাঝে ইতিবাচকতা ছড়াতে গিয়ে তারা কি পুরো বিষয়টাকেই নেতিবাচক করে তুললেন না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *