ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর

—– তাহা ইয়াসিন

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শোকাভিভূত । অনেকের মৃত্যুতেই আমরা শোকাভিভূত হই কিন্তু তাঁর জন্য শোকের কারণ আরো গভীর থেকে । এমন কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিশীল মেধা কিংবা অনন্য সাধকের সংখ্যা শতকে হাতেগোণা। তাঁর এসব গুণাবলী আমাদের স্মৃতি আর সময়কে দখল করে নিয়েছে । দৈহিকভাবে মারা গেলেও তিনি অনেকদিন আমাদের মাঝে থাকবেন । ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৩০টিরও বেশি ভাষায় কয়েক হাজার গান গেয়েছেন তিনি। বলিউডের বহু প্রজন্মের নায়িকারা তাঁর কন্ঠে ঠোঁট মিলিয়েছেন। মধুবালা থেকে শুরু করে মাধুরী দীক্ষিত, প্রীতি জিনতা, কাজলসহ অনেক শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের প্লে-ব্যাকে লিপসিং করেন। তিনি এক হাজারের বেশি ছবিতে গান করেছেন। তাঁর কন্ঠে তোলা গানের সংখ্যা ৭ হাজারেরও বেশি। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে ৯২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালে ভারতের ইন্দোরে।

লতা মঙ্গেশকর সঙ্গীত জগতে প্রবেশের আগে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি ‘ কিতি হাসাল’ – এ প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন গুলাম হায়দার। এরপর গানের সাথেই লেগে থাকেন তিনি এবং গানই হয় জীবনের একমাত্র সাধনা। ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকি’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে ‘, ‘আমি যে কে তোমার ‘, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় শ্রান্ত পাখিরা ‘ ‘ গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি, আমায় চমকে দাও চমকে দাও,’ প্রভৃতিসহ প্রায় ১৮০ টি বাংলা গানেও তিনি কন্ঠ দিয়েছেন। ২০০১ সালে তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান, ‘ভারতরত্ন’-এ ভূষিত করা হয়। এর আগে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানও পান । ১৯৮৯ সালে চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘দাদা সাহেব ফালকে’ দ্বারাও সম্মানিত হন তিনি। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ‘রয়্যাল অ্যালবার্ট ‘ হলে সংগীত পরিবেশন করেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘লেজিও দনরের অফিসার’ খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও আরো অনেক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

একাগ্রচিত্তে সংগীত সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর সুরেলা কন্ঠের জন্য তাঁকে বলা হতো ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’। তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বাইরে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাঁর মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। শেষকৃত্যে মুখাগ্নি করেন তাঁর ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। লতা মঙ্গেশকর সারাজীবনই পারিবারিক বন্ধনে সবার সাথে মিলেমিশে ছিলেন।পাঁচ বছর বয়স থেকেই পিতার কাছে তাঁর গানের তালিম শুরু হয় । তাঁর পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন স্বনামধন্য মারাঠি অভিনেতা ও ভারতীয় ক্লাসিকাল শিল্পী। তাঁর মাধ্যমেই লতা মঙ্গেশকরের অভিনয়ের শুরু। তের বছর বয়সে যখন লতা মঙ্গেশকরের গানের ক্যারিয়ার শুরু ঠিক তখনই পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর মৃত্যুবরণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই বড়। তাই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকেই। মূলত গান গেয়েই পরিবার চালানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন তিনি। তাঁর ছোটো ভাইবোন, আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর,মীনা মঙ্গেশকর, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর সংগীতের নানা অঙ্গনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের ফান্ডে আর্থিক সহায়তা ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করেন লতা মঙ্গেশকর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *