‘এ’ কার : দুটি ভিন্ন রূপ ও প্রয়োগ

মাধবী লতা

মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়ের জন্যে মানবকন্ঠ নিঃসৃত অর্থপূর্ণ ধ্বনিসমষ্টির নামই ভাষা। স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতা দূর করে ভাষাকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে সৃষ্ট হয়েছে লেখনরীতি। একটি সুসংহত লেখনরীতির জন্য ভাষার নিজস্ব বানানরীতি একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর কোনো ভাষায়ই ধ্বনি ও বর্ণের শতভাগ প্রতিসাম্য নেই। তাই মানুষ যা বলে তাই যেমন সে লেখে না, তেমনই যা লেখা হয় তাই উচ্চারিত হয় না। এটি ভাষার স্বাভাবিক ধর্ম। একটি ভাষা ব্যবহারকারী ভাষিকগোষ্ঠী দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ও চর্চায় ধ্বনি-বর্ণের এই অপ্রতিসাম্যতার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ভাষা ব্যবহারে সক্ষম হলেও ভাষাকে তার ব্যবহারকারীদের কাছে সহজতর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বানান সংস্কারের প্রচেষ্টা হয়েছে। বাংলা বানানের সংস্কৃত মানরূপ প্রণয়নের আগে প্রাচীন লিপিকরদের বানানে এক রকমের স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। বানানে শৃঙ্খলা আনয়নের উদ্দেশে বাংলা বানান সংস্কার এবং বানানরীতি সুনির্দিষ্ট করার প্রথম আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় বাংলা ভাষা ও বানান প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।

বাংলা মুদ্রণে মাত্রাহীন ‘এ’ কার ও মাত্রাযুক্ত ‘এ’ কারের পার্থক্য রয়েছে। ‘এ’ কারের এই দুটি ভিন্ন রূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাপ্রসূত। ‘ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক বিষয়গুলো বর্ণণা করে লেখা ‘সহজপাঠ’ বইতে দু’রকম ‘এ’ কারের ব্যবহার রবীন্দ্রনাথ বর্ণণা করেছেন। বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি ৭টি- ই, এ, এ্যা, আ, অ, ও, উ ৷ ‘এ’ এবং ‘এ’-কারের উচ্চারণে আমরা দুটি রূপ পেয়ে থাকি- সংবৃত উচ্চারণ (‘এ’ ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ অর্থাৎ ‘এ’) এবং বিবৃত উচ্চারণ (‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে ‘এ্যা’ )।

ছবি : সহজপাঠ, প্রথম ভাগ (পৃষ্ঠা : ৫)

‘এ’- কারের উচ্চারণ ভিন্নতা (‘এ’ এবং ‘এ্যা’ ) নির্দেশকল্পে রবীন্দ্রনাথ ‘এ’-কারের মুদ্রণে মাত্রাযুক্ত ও মাত্রাহীন ব্যবহার প্রচলন করেন। শব্দের শুরুতে মাত্রাহীন ‘এ’ কার হলে ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে সংবৃত আর মাত্রাযুক্ত ‘এ’ কার হলে ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে বিবৃত। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে। ‘মেলা’ শব্দটি মাত্রাহীন ‘এ’কার দিয়ে লিখিত হলে তার সেই ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে সংবৃত বা স্বাভাবিক; অর্থাৎ শব্দটির উচ্চারণ হবে ‘গেলা’ শব্দটির ‘এ’ ধ্বনির অনুরূপ। যেমন: দেবী, সেরা, সেই, বেদনা, মেয়ে, গেলা, জেলা ইত্যাদি। অপরদিকে শব্দের আদিতে মাত্রাযুক্ত ‘এ’ কার হলে ‘এ’ ধ্বনির উচ্চারণ হবে বিবৃত; অর্থাৎ ‘মেলা’র উচ্চারণ হবে ‘ম্যালা’ যা ‘ঠেলা ‘শব্দটির ‘এ’ ধ্বনির অনুরূপ। তদ্রুপ- কেমন, যেমন, যেন, ফেনা ইত্যাদি।

কেউ কেউ মনে করেন, শব্দের শুরুতে সর্বত্রই মাত্রাহীন ও শব্দের মধ্যে ও অন্তে মাত্রাযুক্ত ‘এ’-কার বসবে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। মাত্রাযুক্ত ‘এ’-কার ‘এ্যা’ ধ্বনির প্রতীক আর মাত্রাহীন ‘এ’-কার ‘এ’ ধ্বনির প্রতীক। তবে এই নিয়মের কিছু অসুবিধেও রয়েছে। শব্দের মধ্যে ও অন্তে মাত্রাহীন ‘এ’-কার লেখা হয় না। সেক্ষেত্রে কি ‘এ্যা’ উচ্চারিত হবে? ‘বিশেষ’, ‘নিবেদন’, ‘তোমাকে’ এ শব্দগুলোর উচ্চারণ কি হবে ‘বিশ্যাষ’, ‘নিব্যাদন’ ‘তোমাক্যা’? সুতরাং মাত্রাযুক্ত ‘এ’-কার ‘এ্যা’ ধ্বনির প্রতীক এই কথাটি শব্দের আদিতে প্রযুক্ত হবে ধরে নিলে জটিলতা কিছুটা এড়ানো সম্ভব। এ’ কারের এই নির্দিষ্ট ব্যবহার সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম অনেকটাই অন্ধকারে রয়েছে। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে এ সংক্রান্ত আলোচনা তাই অত্যন্ত প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *