নজরুলের চোখে ক্ষুদিরাম

তাহা ইয়াসিন

স্বাধীনতার যে স্বপ্ন নিয়ে পরাধীন ভারতে কিশোর ক্ষুদিরাম আত্মদান করেছিলেন তা বিভক্ত স্বাধীন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সেদিনের ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এই তিনটি দেশ মিলে। তিনটি দেশেই আজ ব্যাভিচারী রাজনীতি, দেশসেবার নামে আত্মসেবা, দেশবাসীর স্বার্থরক্ষার নামে কার্যত ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষাই মূল উদ্দেশ্য হিসেবে সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ক্ষুদিরামসহ আরো অগণিত বীরদের কাছে এরকম ভূখণ্ডপ্রাপ্তি ছিল চিন্তার অতীত। ক্ষুদিরামের কৈশোরের চেতনাতেই রাজনীতি ছিল হৃদয়বৃত্তি ও জীবনের মহত্তম আদর্শ – যার জন্য হাসিমুখে জীবন পর্যন্ত দেওয়া যায়।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৎকালীন লর্ড কিংসফোর্ডকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামের (১৮৮৯-১৯০৮) ফাঁসি কার্যকর করে। এরপর ক্ষুদিরামকে নিয়ে পীতাম্বর দাস বাউলের লেখা ” একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ” গানটি সর্বকালের অতি জনপ্রিয় গানে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগণিত স্বদেশী আন্দোলনকারীর মুখে মুখে ধ্বনিত হতো এই গান। ভারতবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি কতটুকু দগ্ধ করেছিল এই গানটির মাধ্যমে তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে । ক্ষুদিরামের সাহসী আত্মত্যাগ এবং প্রতিরোধ পরায়ণতা বাঙালির বীরত্বের প্রতীক হয়ে আছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাঙালি মায়েদের প্রয়োজনে সন্তান বিসর্জনের আকুল বেদনা এবং প্রতিশ্রুতি প্রকাশিত হয়েছে এই গানে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের হৃদয় সিক্ত ছিল স্বদেশী এই বীরদের চেতনায়। ক্ষুদিরামকে নিয়ে তিনি ওই বিখ্যাত গানের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছিলেন তাঁর অগ্নিঝরা প্রবন্ধ ‘ক্ষুদিরামের মা।’ নজরুল দেশের জন্য ফাঁসির কাষ্ঠে প্রাণ বিসর্জনকারী বীর ক্ষুদিরাম, বাঘা যতিন, যতিন দাস প্রমুখের চেতনা বুকে ধারণ করেই সাহিত্যের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। সে কারণেই দেখা যায় সাহিত্য জীবনের শুরুতেই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি কবিতা লেখার কারণে এক বছর জেল খাটেন।

‘ ক্ষুদিরামের মা’ প্রবন্ধে নজরুল বলেছেন,

‘ ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময়ের একটি গানে আছে, ক্ষুদিরাম বলছেন
“আঠার মাসের পরে
জনম নেব মাসীর ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি’’
সেই হারা-ক্রন্দনের আশ্বাস-গান শুনে আজো অতি বড় পাষাণী মেয়েরও চোখে জল আসে, গা শিউরে ওঠে। আমাদের মত কাপালিকেরও রক্ত-আঁখি আঁখির সলিলে টলমল ক’রে ওঠে। কিন্তু বলতে পার কি দেশের জননীরা, আমাদের সেই হারা-ক্ষুদিরাম তোমাদের কার ঘরে এসেছে? তোমরা একবার তোমাদের আপন আপন ছেলের কণ্ঠের পানে তাকাও, দেখবে— তাদের প্রত্যেকের গলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির নীল দাগ। ‘

দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করছেন অগণিত শহীদ। নজরুল সেই সকল শহীদদের কথা স্মরণ করে বর্তমান মায়েদের উদ্দেশে একথা লিখেছেন। তিনি মায়েদের জানান ক্ষুদিরামপ্রমুখ বীর শহীদদের গলায় যে ফাঁসির রজ্জু ছিল তার দাগ যেন প্রতিটি সন্তানের গলায় নীল দাগ হয়ে আছে।

নজরুল দেশের মা-দের জানিয়েছেন ক্ষুদিরাম ছিলেন মাতৃহারা। সে কোন্ মাকে ডেকে আবার আসবে ব’লে আশ্বাস দিয়ে গেছেন , কেঁদে গেছেন , তা যদি বুঝতে বাঙলার মা’রা, তা হ’লে দেশের প্রত্যেক মাদের ঘরে একটি করে ছেলে আজ ক্ষুদিরাম হ’ত।

ক্ষুদিরাম বসু

ক্ষুদিরাম ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে পেয়েছিলেন সারা দেশের মায়েদের এবং দেশকে মা ডেকেছেন। এই দেশমাতৃকার জন্য ক্ষুদিরাম হাসিমুখে ফাঁসির রজ্জুতে প্রাণ দেন।

নজরুল ক্ষুদিরামের আবার ফিরে আসার আবেদনের মধ্যে দেশপ্রেমের অতৃপ্ত বাসনাকেই রূপায়ন করেছেন। মাতৃহীনের মাতৃক্ষুধায় দেশপ্রেমের যেন গভীর করুণ দৃশ্যপট-সমকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

স্বাধীনতার জন্য প্রাণ ‘আহুতি’দেওয়াকে নজরুল মহান কর্তব্য বলে মনে করেছেন। তিনি লিখেছেন –

‘ দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের,
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের। ‘

ক্ষুদিরামের দিদি অপরূপা দেবী বলেছিলেন, ‘ তিনমুঠো ক্ষুদ দিয়ে ক্ষুদিরামকে কিনেছিলাম আমি। মনে মনে লোভ ছিল, ক্ষুদিরামকে একা ভোগ-দখল করব। কিন্তু কখিন যে আমার অগোচরে সে দেশের লোকের কাছে বিকিয়ে গেছে জানতেও পারি নি। তিনমুঠো ক্ষুদ দিয়ে আমি কিনেছিলাম। দেশের ছেলেরা তাকে কিনলো আঁজলা আঁজলা রক্ত দিয়ে।’

‘ বন্দে মাতরম! মাকে বন্দনা করে বিদেশি শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত মাতৃভূমিকে মুক্ত করার যে দীক্ষা ক্ষুদিরাম দিয়ে গেছেন সেই পথ ধরে দেশপ্রেমের আশ্চর্য উন্মাদনা জেগেছিল। নজরুল সেই দৃপ্ত চেতনায় অগ্নিঝিরা গান, কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করে মুক্তিকামী স্বদেশি আন্দোলনকারীদের শ্লোগানের ভাষা দিয়েছেন। তিনি ক্ষুদিরাম, বাঘা যতিন, যতিন দাস প্রমুখ বিপ্লবীদের নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ লিখে তরুণদের উজ্জীবিত করেন।

নজরুল নিজের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু ‘ পত্রিকার ৬ষ্ঠ সংখ্যায় ক্ষুদিরামের ছবি ছাপেন। ছবির উপরে লেখেন, ‘ বাঙলার প্রথম শহীদ। ‘ ৮ম সংখ্যায় ছাপেন তেজস্বী ঘোড়াসহ যতীন্দ্রনাথের ছবি। যতীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখা হয়। নিবন্ধের শিরোনাম ‘ বাঙলার বিপ্লব-যুগের প্রথম সেনানায়ক -পুরুষ সিংহ যতীন্দ্রনাথ।’
এভাবে নজরুল দেশ-বিদেশের বিপ্লবীদের ছবি এবং বিদ্রহাত্মক ক্যাপশন কিংবা নিবন্ধ লিখে সমকালে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। নজরুলের এই চেতনাদীপ্ত প্রেরণা ছিল ভিত্তিশীল এবং স্থায়ী। সে কারণে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রথম সারিতে একজন কলম সৈনিক হিসেবে নজরুল অমর হয়ে আছেন। ক্ষুদিরামের মা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধটিতে নজরুল আরো লিখেছেন,

‘ মায়ের সাড়া পায় নাই, মা’রা তাকে কোলে নেয়নি, তাই অভিমানে সে আত্মবলিদান দিয়ে আত্মনির্যাতন ক’রে মায়েদের অনাদরের প্রতিশোধ নিয়েছে। যাবার বেলায় দস্যি ছেলে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে গেল না। হায় হতভাগা ছেলে! কার জন্যে সে কাঁদবে? যার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই, তার চোখের জল যে লজ্জা, তা’র কাঁদাটাও যে অপমান। দস্যিছেলে সব চোখের জলকে কণ্ঠের নীচে ঠেলে রাখলে। ফাঁসি প’রে নীলকণ্ঠ হবার আগেই ব্যথায় নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। প্রাণের তিক্ত ক্রন্দনের জ্বালা তার কেউ দেখলে না, দেখলে শুধু কিশোর ঠোঁটের অপূর্ব হাসি। ফাঁসি হ’তে আর দু’চার মিনিট বাকী, তখনও সে তার নিজের ফাঁসির রশির সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত যে, ফাঁসির রজ্জুতে মোম দেওয়া হয় কেন! তোমরা কি ভাবছ মা যে, কি সাংঘাতিক ছেলে বাপু! কিন্তু ছেলে যতই সাংঘাতিক হোক, সত্যি করে বল দেখি, ঐ মাতৃহারা তোমাদেরই মুক্তির জন্য ফাঁসিতে যাওয়ার কথা শোনার পরেও কি তোমরা নিজেদের দুলালদেরে বুকে ক’রে শুয়ে থাকতে যন্ত্রণা পাও না? ঐ মাতৃহারার মরা লাশ কি তোমাদের মা ও ছেলের মধ্যে এসে শুয়ে একটা ব্যবধানের পীড়া দেয় না? নিজের ছেলেকে যখন আদর করে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় যাবতীয় সামগ্রী খাওয়াও, নিবিড় স্নেহে বুকে চেপে ধরে শুয়ে ঘুম পাড়াও, একটু অসুখ করলে তেত্রিশ কোটি দেবতার পায় মাথা খোঁড় তখন কি এই মাতৃহীন ক্ষুদিরামের কথা– তারই মত আরো সব লক্ষ্মী-ছাড়া মাতৃহারাদের কথা মনে হয়ে তোমাদের বুকে কাঁটার মত বেঁধে না? তোমাদের এতো স্নেহ এত মায়া কি অনুশোচনায়, লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠে না? বল মা, উত্তর দাও! আজ ঐ ক্ষুদিরামের মত শত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে এসে তোমাদেরে তোমাদের মাতৃহৃদয়ের নামে জিজ্ঞাসা করছে, উত্তর দাও! জানি, উত্তর দিতে পারবে না, মুখে কথা ফুটবে না। তুমি বলতে যাবে, কিন্তু অমনি তোমার মনের মা তোমার মুখ টিপে ধরবে!

মানুষের মন আর আত্মা এমনি বালাই যে, পরের দুঃখ দেখে তার নিজের ভোগ বিস্বাদ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে মা-দের। মাতৃহারা এক পাশে দাঁড়িয়ে জল-ছলছল চোখে যদি চায়, তা’হলে তোমার হাত উঠবে না তোমার ছেলের মুখে কিছু তুলে দিতে, আপনি শিথিল হয়ে যাবে। এটাও সওয়া যায়। কিন্তু যদি কোনো মাতৃহারা বিদ্রোহ ক’রে কারুর কাছে কিছু না চায়, মাথা উঁচু ক’রে কোনো মায়ের ঘরের পানে না তাকিয়ে তার রুক্ষ কেশ লক্ষ্মীছাড়া মূর্তির রুদ্রকেতন উড়িয়ে চলে যায়, ডাকলেও ঘরের পানে তাকায় না, মায়ের ডাকে চোখ ছলছল না ক’রে উল্টো আত্মনির্যাতন করে তোমাদের চোখের সামনে,তা’হলে মায়ের মন কেমন ক’রে ওঠে বল দেখি? হে আমার দেশের জননীরা! তোমাদের কাছে এসেছে তেমনি বিদ্রোহী লক্ষ্মীছাড়া মাতৃহারার দল, তাদের হারানো ক্ষুদিরামকে খুঁজে নিতে। ভয় করো না, বিদ্রুপ করো না এদের মা, এরা ভিখারী ছেলে নয়। আমরা তোমাদের কাছে করুণা ভিক্ষা করতে আসিনি, আসবও না। আমরা এসেছি আমাদের দাবী নিয়ে, আমাদের হারানো ক্ষুদিরামকে ফিরে নিতে। সে যে আমাদের মাতৃহারার দলের, সে মায়ের দলের নয়।

ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে। তোমরা চিনতে পারছ না, তোমরা মায়ায় আবদ্ধ। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাদের ক্ষুদিরামকে– তোমাদের ছেলেদের ছেড়ে দাও, ওরা আমাদের — আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দলের। ওরা মায়েদের নয়, ওরা ঘরের নয়, ওরা বনের। ওরা হাসির নয়, ফাঁসির। ঐ যে কণ্ঠে হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরছ, ঐ কণ্ঠে ফাঁসির নীল দাগ লুকানো আছে। ওরা তোমার নয়, আমার নয়, ওরা দেশের, ওরা বলিদানের, ওরা পূজার।

কোথায় প্রতি ঘরে ঘরে। কিন্তু আঠার বছর যে কেটে গেল ভাই, সাড়া দাও সাড়া দাও আবার, যেমন যুগে যুগে সাড়া দিয়েছ ঐ ফাঁসি-মণ্ডপের রক্ত-মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তোমার সাথে আমাদের বারবার দেখাশুনা ঐ ফাঁসি-পরা হাসি-মুখে! আর একবার সাড়া দিয়েছিলে তুমি আয়র্ল্যাণ্ডে রবাট এমেট নামে। সেদিনো এমনি তরুণ বয়সে তুমি ফাঁসির কৃষ্ণ-আলিঙ্গন, খড়গের সুনীল চুম্বন পেয়েছিল। হারা প্রিয়া ‘সারা’র আলিঙ্গনপরশ তোমার জন্য নয়, কমলার প্রসাদ তোমার জন্য নয়, তোমার প্রিয়ার তুমি এমনি বারে বারে পাবে আবার বারে হারাবে, তোমার প্রিয়ার চেয়েও প্রিয়তম ঐ ফাঁসির রশি। কোথায় কোন্ মাতৃ-বক্ষে কোন্ “সারা”র কোন্ কমলার কুঞ্জে আপন ভুলেছ, হে ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা। সাড়া দাও! সাড়া দাও! এস আবার ফাঁসিমঞ্চে, আর একবার নতুন ক’রে আমাদের সেই চির-নূতন চির-পুরাতন গান ধরি
“আঠার মাসের পরে,
জনম নেব মাসীর ঘরে, মা গো
চিনতে যদি না পার মা,
দেখবে গলা ফাঁসি!’

নজরুল ক্ষুদিরামের অভিমানের কথা লিখেছেন এভাবে যে, মায়ের স্নেহবঞ্চিত হয়ে ক্ষুদিরাম একফোঁটা অশ্রু বিসর্জন না করে প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু দেশপ্রেম এবং মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ক্ষুদিরাম যুগে যুগে বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নেবে । আবার বাংলার তরুণরা সেই চির-পুরাতন, চিরনতুন গান ধরবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *