তানিয়া এক মৃত্যুহীন প্রাণ
-নুরন্নবী মোস্তফা
তানিয়া যার অপর নাম জয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎনি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত রাশিয়াকে মুক্ত করার জন্য রাশিয়ার যে বীর যোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন তানিয়া তাদের একজন। তানিয়া ছিল আঠারো বছরের তরুনী। তার বুদ্ধিমত্তা এবং দেশের জন্য যে অঙ্গীকার তা কালে কালে মানব সমাজকে আলোড়িত করবে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে পেট্রিশ্চেভ অঞ্চলের ভেরিয়া শহরের নিকট জার্মান সৈন্যরা তাকে চূড়ান্ত পাশবিক নির্যাতনের পর ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
তানিয়া ওই অঞ্চলের এক জার্মান সেনাশিবিরের আস্তাবলে আগুন দেয়ার সময় ধরা পড়ে। মেয়ে হলেও তার পোশাক ছিল সৈনিকের। ধরা পড়ার পর শত্রুপক্ষ তাকে মেয়ে হিসেবে চিনতে পারে।
‘ সৈনিককে একটি ঘরে নেয়া হলো। সেখানে সকলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো সে একটি মেয়ে। একেবারে কম ববয়সী। দীর্ঘায়ত চেহারা। গাত্রবর্ণ জলপাইয়ের মতো। চোখের ভুরু জোড়া কালো। কালো ক্লিব করা মাথার চুল উপরের দিকে ব্রাশ করা। ‘
তাকে ঘুষি,প্রহার এবং জুতোর আঘাত করা হয়। এরপর আন্ডারওয়ার পরিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় খালি পায়ে বরফের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। জার্মান সেনা-অফিসার তানিয়াকে নানাভাবে নির্যাতন করে জানতে চায় স্টালিনের কথা। জানতে চায় স্টালিন কোথায় আছেন?
তানিয়া প্রথম দিকে কিছুই বলেনা। নির্যাতনের এক পর্যায়ে বলে তিনি তাঁর অফিসে আছেন। ব্যাস এ পর্যন্তই। এরপর তার উপর চলে অকথ্য নির্যাতন। তানিয়াকে জেরা করা হয়! কে তাকে পাঠিয়েছে? তার সাথে কারা কোথায় আছে ইত্যাদি। সে শুধুই বলে- ‘আমি জানি না – আমি বলবো না, না। ‘
চারজন তরুন সৈন্য কোমরের বেল্ট খুলে তানিয়াকে নির্মম প্রহার করে, চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে কিন্তু তানিয়ার একই উত্তর, ‘ আমি জানি না, আমি বলবো না।’ ফ্যাসিস্টদের অত্যাচারের সময় সে দাঁতে ওষ্ঠধর কামড়ে ধরে। তার দাঁতে মাংস কেটে বসে যায়। নাঙ্গা পায়ে, নাঙ্গা গায়ে এই অত্যাচারের পর বরফের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে ফেলে রাখা হয় একটি ঘরে।
পরদিন ফাঁসি দেয়া হয়। রাশিয়ান ভূমিতে রক্ত-নদী বইয়ে অসংখ্য আত্নাকে ফাঁসিকাঠে লটকিয়ে জার্মানেরা তাদের পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করেছিল।
ফাঁসির পরদিন তার দেহ ধারালো ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে মৃতদেহের উপর চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। স্থানীয় কৃষকদের দ্বারা কবর খুঁড়ে তাকে দূরে অশ্রদ্ধার সাথে পুতে রাখা হয়।
‘কোন রকমের সন্মান ব্যতিরেকে মৃতদেহকে কবরে নামানো হলো। একটা উইলো গাছ ক্ষণে ক্ষণে দুর্বোধ্য ভাষায় কেঁদে উঠছিলো। হঠাৎ এক ঝলক তুষারঝটিকা এসে কবরটা ঢেকে দিয়ে গেল। ‘
তাকে হত্যা করার পর রাশিয়ানরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হিটলার বাহিনীকে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত করে।
‘ হিটলারের বর্বর অনুসারীরা মহানুভব মেয়ে সৈনিকটির উপর যে অত্যাচার করেছিল সে বিষাদময় ফাঁসির বর্ণনা দেয়ার জন্য একজন মাত্র লোক বেঁচে ছিলো। যে সমস্ত স্থানে সে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল,সে সমস্ত স্থান সংরক্ষিত করে রাখা হলো। তানিয়ার কবর সমগ্র রাশিয়ার জনসাধারণের তীর্থকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো। ‘
তানিয়া ওরফে জয়ার মা বেতার বক্তৃতায় বলেন,
‘ জয়াকে কেউই ভুলতে পারবে না ভেবে আমি আনন্দিত হই। আমার মাতৃহ্রদয়ে যতোদিন শোণিতধারা প্রবাহিত হবে, ততোদিন পর্যন্ত জয়া জীবিত থাকবে যখন আমি থাকবো না তখনো জয়া আপনাদের হ্রদয়েও বেঁচে থাকবে। এমনকি আপনাদের সন্তান-সন্ততিরাও তাকে কারুণ্য বিগলিত স্বরে স্বরণ করবে। ‘ একজন মায়ের এর চেয়ে পৃথিবীতে আর কি গর্বের হতে পারে?
গর্ভধারিণী মা হিসেবে তিনি সার্থক যাঁর সন্তান একটা দেশের জন্য বীরের ন্যায় নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরেছে। পৃথিবীতে মানুষ জন্মে অনেক কিন্তু বীরের জন্ম হয় অল্প। সকল তুচ্ছতা পায়ে ঠেলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবিচলভাবে মৃত্যুকে যে বরণ করে নিতে পারে সেই যথার্থ মানুষ, সেই যথার্থ বীর, সার্থক তাঁর মানব জনম।
তানিয়া ভালোবাসতো রাশিয়ার ইতিহাস এবং সাহিত্য। সে ছিল একজন যথার্থ সৈনিক। দেশের ইতিহাস, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যে ছিল তার গর্ব। একজন তরুন সাম্যবাদী লীগের সদস্য হিসেবে তার যে সচেতনতা ছিল সেটি তার ডায়েরীর লেখায় ছিল। তানিয়া ডায়েরীতে লিখেছিল কিছু উদ্ধৃতি,
” মানুষের কাপড়-চোপড়,আত্না,চিন্তা,মুখমন্ডল সব কিছু সুন্দর হওয়া উচিত। “– শেখভ
” সাম্যবাদী হওয়া মানে সাহস করা, চিন্তা করা, আশা করা এবং ঘাড়ে দায়িত্ব নেওয়া। “–মায়াকভস্কী
” ভালো না বেসে চুমু দেয়ার চাইতে মৃত্যুবরণ করা ঢের ভালো। “–চেরণশেভস্কী
” আমি দশজন ফরাসির সঙ্গে একজন রাশিয়ান বদল করতে রাজি নই। ” কতুজভ
” গোলাকার সূর্যের সন্তানেরা কবিতায় কি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং মানবাত্নার প্রতি মমত্ববোধ বর্তমান। “
তার ডায়েরীতে এসব উদ্ধৃতি ছাড়াও লেনিন, স্তালিনের প্রতি ছিল আন্তরিকতার প্রকাশ।
দেশ এবং দেশের নেতৃত্বের প্রতি গভীর ভালোবাসা যেমন ছিল তেমনি দেশের জন্য অন্তহীন ভালোবাসা তানিয়াকে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করতে মনোবল যুগিয়েছে।
রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিপ্লবের পর যৌথখামার পদ্ধতিতে দেশের সার্বিক উন্নতিও হতে শুরু করে। খামার পদ্ধতি প্রতিষ্টা করা সহজ হয়নি। জনগন পুরণো চিন্তাকাঠামো থেকে সহজে যে বের হতে চায়না সেটি তানিয়ার এলাকার বর্ণনা থেকে জানা যায়।
তানিয়া তার যখন সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয় তখন তার মা চোখের জল ফেলেছিল। তানিয়া মাকে জল ফেলতে বারণ করে এবং জানায়, ‘ মা মণি তুমি কেঁদোনা, আমি বীরঙ্গনার মতো ফিরে আসবো অথবা মৃত্যুবরণ করবো। ‘
সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার জীবন যখন ক্রমশ উজ্জল থেকে উজ্জলতর হয়ে আসছিল তখনই অর্থাৎ ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহন করে তানিয়া। আর তরুণ সাম্যবাদী লীগে যোগদান করে ১৯৩৮ সালে। ১৯৩৩ সালে তানিয়ার পিতা মারা যায়। তারপর থেকে সে নিজের প্রতি বেশী যত্নশীল হয় এবং নিজের পড়াশুনা নিজেই করতো।
টলস্টয়, গোর্কি, নেক্রাসভ, চেরনিসেভস্কী নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি তাকে ত্যাগ,তিতিক্ষা এবং ধৈর্য্যের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তানিয়া তার পিতৃভূমিকে, পিতৃভূমির মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। বড় হলে তার সাহিত্যিক হওয়ার আকাঙ্খা ছিল।
অন্যদিকে ইতিহাসের দিকেও জয়ার গভীর আকর্ষণ ছিল। সে আলেকজান্ডার নেভস্কী, আলেকজান্ডার ডনভস্কী,আলেকজান্ডার শোভারভ এবং মাইকেল কুতুজভের উপর অনেক পড়াশোনা করেছিল। রাশিয়ার এই বীরগণ সম্পর্কে জানতে গিয়ে স্বদেশের ইতিহাসের গভীরে তার প্রবেশ ঘটে।
তানিয়া সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার আবহে গড়ে ওঠা দেশপ্রেমিক তরুন সেনানী। পিতৃহীনতার জন্য সে ছিল প্রচন্ড আত্নসচেতন, দেশের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসসচেতনতা এবং সাহিত্যসাধনার বুকভরা স্বপ্নতাড়িত তানিয়া দেশের জন্য জীবন দেয়ার উদ্দেশে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই যায়। জার্মান ফ্যাসিস্ট দ্বারা আক্রান্ত ভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অপারেশনে অংশগ্রহন করে ।
যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের জয়-পরাজয় থাকে । পরাজিত হলে পরিণতি মৃত্যু। দূর্ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ শত্রুর হাতে ধরা পড়ে। তানিয়াও ধরে পড়ে নির্যাতনের মধ্যদিয়ে প্রাণ হারায়। প্রকৃত বীরসেনানী নির্যাতনকে তুচ্ছ মনে করে। তানিয়া বর্বরোচিত, অত্যাচারের পরও পিতৃভূমির কোন তথ্য প্রদান করেনি।
সেকারণেই আজ রুশ জনগনের হ্রদয়ে চিরদিনের শ্রদ্ধেয় হয়ে আছে তানিয়া। জয়া কসমোডেমিয়ানস্কাইয়া (তানিয়া) বীরাঙ্গনা হিসেবে সোভিয়েত ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। মানুষের জীবন ক্ষনস্থায়ী নয়। জীবন মানব-ইতিহাসের সমান বড় হতে পারে তার উদাহরণ তানিয়া।
আরও পড়ুন …
তাহসান-মিথিলার লাইভ: ব্যক্তিগত সম্পর্ক যখন পণ্য
বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে নারীর অবস্থান
মাদাম কুরীঃ নিজের আবিষ্কৃত রিডিয়ামের তেজস্ক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন!