মাদাম কুরীঃ নিজের আবিষ্কৃত রিডিয়ামের তেজস্ক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন!


—– মর্জিনা খাতুন

চরিত্রে অটল দৃঢ়তা, স্বাধীন, তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন, বিজ্ঞানে আত্মোৎসর্গকারী, প্রশংসাবিমুখ ও নিভৃতচারী আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের অন্যতম পথিকৃৎ মাদাম মারী কুরি ওরফে মানিয়া শক্লোদোভস্কা। আদরের নাম ছিল মানিয়া। জন্ম ৭ নভেম্বর ১৮৬৭ সালে, পরাধীন পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে। বাবা ব্লাদিস্লাভ শক্লোদোভস্কি ছিলেন গণিত ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তৎকালীন বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে তিনি পড়াশোনা করতেন। মা মাদাম শক্লোদোভস্কা একটি বালিকা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মানিয়া ছিলেন সবার ছোট। বয়স হবার আগেই মানিয়া পড়তে শিখেছিলো। বাবা-মা সযতেœ বই-পত্র আড়াল করে রাখতেন, বয়সের তুলনায় অতি মেধা যেন তাঁর ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ছোট বয়সেই তাঁর বড় আকর্ষণের বিষয় ছিল বাড়িতে যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো বাবার ঘরটি। বাবার ঘরের সামনে এসে মানিয়া অবাক হয়ে দেখতো হরেক রকম কাঁচের টিউব, ছোট দাঁড়িপাল্লা আর নানা ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। এই জিনিসগুলোর প্রতি তন্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবা শুধু বলে দিলেন, ‘ফিজিক্সের যন্ত্রপাতি’। সেই থেকে শব্দ দুটি মানিয়ার স্মৃতিতে যাদুমন্ত্রের মতো গাঁথা ছিল।

মানিয়ার শৈশব কেটেছে জার শাসিত পোল্যান্ডে। জারের নিষ্ঠুর শাসনের যে প্রতিবাদ করতো তাকে হত্যা করে মৃত্যুদেহ শহরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে দলে দলে সাইবেরিয়ার তুষার পথে হাঁটতে হাঁটতে নির্বাসন পাঠানো হতো। মাদাম কুরির বাবা-মা জারের এই নিষ্ঠুর শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন পোল্যান্ড চেয়েছিলেন। ফলে পোল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন তারা। এই অপরাধে বাবার চাকরি চলে যায়। তখন সামান্য আয়ের পরিবারে নেমে এসেছিল আর্থিক বিপর্যয়। বাবা অমানুষিক পরিশ্রম করে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে লাগলেন। বাবার স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের বড় মানুষ করে তুলবেন। এই আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে মানিয়ার এগারো বছর বয়সে মা রাজযক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কৈশোরে মাকে হারিয়ে পন্ডিত ও স্বাধীনতাকামী বাবার তত্ত্বাবধানে এক জ্ঞান সমৃদ্ধ পরিবেশে মানিয়া বেড়ে ওঠতে শুরু করল।

প্রিয় মাকে হারানোর ব্যথা ভুলে থাকার জন্য মানিয়া বাঁচার তাগিদে বইয়ের জগতে ঢুকে নিজেকে চারপাশ থেকে গুটিয়ে রাখত। ধ্যানমগ্ন হয়ে মারিয়া শুধু বই পড়ত। এমনি করে অসাধারণ মেধা আর স্মরণশক্তির অধিকারী মানিয়া ১৮৮৯ সালে স্বর্ণপদক পেয়ে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবার উচ্চশিক্ষা অর্জনের পালা। কিন্তু সে সময় পরাধীন পোল্যান্ডে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার ছিল না। কিন্তু থেমে যাওয়ার ব্যক্তি ছিলেন না মারিয়া ও বড়বোন ব্রনিয়া। প্রয়োজনে উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য পাড়ি জমাবেন স্বাধীন ফ্রান্সে। এর জন্য চাই প্রচুর টাকা। সঙ্গতিহীন পিতার পক্ষে এত টাকা যোগান দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই স্বপ্নের পথে পাড়ি দিতে দুই বোন অমানুষিক পরিশ্রম করে ছাত্র পড়িয়ে টাকা জমানোর চেষ্টা শুরু করলেন।

পরাধীন পোল্যান্ডে দেশপ্রেমের মতো দেশের স্বার্থে বিজ্ঞানচর্চাও ছিল বেআইনী। তাই পোল্যান্ডের সেরা দেশপ্রেমিক বৈজ্ঞানিকদের উদ্যোগে তৈরি ‘ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়ে’ লুকিয়ে লুকিয়ে চলতো বিজ্ঞানচর্চা। মানিয়া আর ব্রনিয়াও যোগ দিলেন তাতে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান লাভ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানশিক্ষা দেওয়া, যাতে ধীরে ধীরে পরাধীন জাতির মধ্যেও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। দেশপ্রেম, মানবজাতির কল্যাণ আর বিজ্ঞানচর্চা এই তিন মন্ত্র মানিয়ার কাছে এক সুরে বাঁধা পড়ে গেল। কিন্তু প্যারি যাওয়ার সঙ্গতি আর কিছুতেই হয়ে ওঠেনা। প্রশ্ন আসল, এতদূর গিয়ে কি তবে থেমে যেতে হবে? উপায়ান্তর না দেখে মানিয়া বড়বোন ব্রনিয়াকে প্রস্তাব দিলেন-“প্রথমে তুমি যাও, আমি আর বাবা মিলে তোমায় টাকা পাঠাবো। তুমি ডাক্তার হয়ে ফিরে এলে আমি যাব, তখন তুমি আমায় সাহায্য করবে।”

ব্রনিয়া যুক্তি করলেন, ‘আমি আগে যাব কেন? এর উল্টোটাও তো হতে পারে। তোর এত গুণ, আমার চেয়েও তোর প্রতিভা বেশি। তুই খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারবি।’ মারিয়া বললেন, ‘ও, এবার কিন্তু তুমি বোকার মতো কথা বলছ। বুঝতে পারছ না, তুমি তো বড় হয়ে যাচ্ছ, তোমার বয়স হল কুড়ি আর আমার সতের। তুমি এতদিন অপেক্ষা করে বসে আছ। আর আমার এখনও অনেক সময় আছে। বাবাকে আমি বুঝিয়েছি এবং তিনিও আমার কথাই ঠিক মনে করেন। তুমি আগে যাবে-এ তো সহজ কথা। তুমি যখন রোজগার করবে, তখন না হয় আমায় সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিও।’ মানিয়ার দায়িত্ববোধসম্পন্ন কথা শুনে ব্রনিয়ার চোখ দুটি জলে ভরে গেল। নাছোরবান্দা মানিয়ার প্রস্তাবে রাজী হয়ে ব্রনিয়া ডাক্তারী পড়ার উদ্দেশ্যে প্যারী রওনা হলেন।

সতের বছর বয়সে মানিয়া নেমে পড়ল জীবনের এক কঠিন লড়াইয়ে। জীবনের কাছে হার না মানা মানিয়া গভর্নেসের চাকরি নিলেন। অর্থাৎ ধনীর বাড়িতে থেকে ছাত্র পড়ানোর দায়িত্ব। আনুষঙ্গিক ব্যয় বাদে বছরে মাইনে ছিল পাঁচশত রুবেল। এর কিছু টাকা পাঠাবে বড়বোন ব্রনিয়ার কাছে, আর কিছু টাকা জমাবে নিজের পড়ালেখার জন্য। কিন্তু তাদের আচার-ব্যবহারে মানিয়া অতিষ্ঠ হয়ে এ কাজ ছাড়তে বাধ্য হলো। কিছুদিন পর মানিয়া এর চেয়ে ভাল বেতনে আরেকটি পরিবারে চাকরি পেল। এই পরিবারে থাকা অবস্থায় একটু সময় পেলেই মানিয়া স্থানীয় লাইব্রেরী থেকে সমাজতত্ত্ব আর পদার্থবিদ্যার বই এনে তার মধ্যে ডুবে যেত। চিঠি লিখে বাবার কাছে অঙ্ক শিখে নিতো। এভাবে টানা তিন বছর গভর্নেসের চাকরির পর অবশেষে প্যারী থেকে ডাক এল। ব্রনিয়ার এই ডাক আসার পর মানিয়ার ক্লান্তিহীন প্রতিক্ষার অবসান ঘটল। মানিয়ার কি আনন্দ! প্রতিটি টাকা-পয়সা হিসাব করে বাবাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানিয়া ট্রেনের ফোর্থ ক্লাস কামড়ায় চড়ে বসল। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-উৎকন্ঠায় দোদুল্যমান মানিয়াকে নিয়ে ট্রেন ছুটল প্যারি অভিমুখে।

১৮৯১ সালের ৩ নভেম্বর বিখ্যাত সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হলেন মানিয়া শক্লোদোভস্কা। প্রফেসর মঁসিয়ে লিপ্ম্যান (পদার্থ বিদ্যায় নোবেল প্রাপ্ত), পোল্ আম্পেলের মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। জ্ঞানপিপাসু মানিয়া একেবারে জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে যেতে চায়। তাই বোন ব্রনিয়া আর জামাতার নিষেধ অগ্রাহ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এক গরিব পল্লীতে বাসা নিল মানিয়া। পরে ছ’তলায় আলো-বাতাসহীন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে চিলেকুঠরি একখানা খুপরি ঘর পেল। মাসে ভাড়া কুড়ি ফ্রাঙ্ক। চূড়ান্ত অভাবে বিপর্যস্ত ও একাগ্র সাধনায় মগ্ন মানিয়ার দিন কাঠতো সেখানে। মাসে চল্লিশ রুবেলের বেশি খরচ করার সাধ্য ছিল না। প্যারিসে হাড় কাঁপানো কনকনে শীতে নিজেকে উষ্ণ রাখার জন্য কয়লা কেনার টাকাও যোগাড় হতো না। এমন বহুদিন কেটেছে যখন প্রচন্ড- শীতে ট্রাংকের সমস্ত কাপড় স্তুপ করে তার উপর বসতেন। কখনও কখনও আলো জ্বালানোর তেল কেনার পয়সাও থাকত না। বছরের পর বছর পাউরুটি ও বেরি ফল খেয়ে কাটিয়েছেন। তাই একমাত্র জুতোজোড়া ক্ষয়ে গিয়ে পা থেকে খুলে পড়লে নতুন এক জোড়া কিনতে হতো খাবার কিংবা আলো জ্বালানোর তেলের খরচ বাঁচিয়ে। অথচ পড়াশোনায় যখন ডুবে থাকতেন এসবের কিছুই তাঁর চিন্তায় স্থান পেত না। বজ্র কঠিন ইচ্ছাশক্তি, কাজ সম্পর্কে নিখুঁত মন, আর অস্বাভাবিক জেদ-এই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ফলে এ হেন দারিদ্রতা হার মেনেছিল তাঁর দুর্বার ইচ্ছাশক্তির কাছে। ১৮৯৩ সালে মানিয়া পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম স্থানের অধিকারী আর পরের বছরে গণিতে অধিকার করলেন দ্বিতীয় স্থান। চরম দারিদ্রের এই চারটি বছর সার্থক হলো মানিয়ার।

দ্বিতীয় বছরে গবেষণার খাতিরে আত্মভোলা কাজ পাগল অসামান্য মানিয়ার সাথে পরিচয় হল পিয়ের কুরির, পিজো-ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কর্তা হিসাবে বিজ্ঞানী মহলে যিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। খুব ছোটবেলা থেকে পিয়ের কুরী বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে এতো এগিয়ে ছিলেন যে, মাত্র আঠারো বছর বয়সে এমএসসি পাশ করে উনিশ বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সম্পূর্ণ আয়েসবর্জিত মানিয়ার মধ্যে বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সন্ধান পেয়ে পিয়ের বৈজ্ঞানিক জীবনে তাঁকে চিরসঙ্গী করতে চাইলেন। কিন্তু উত্তর এল, ‘পোল্যান্ডবাসীর দেশত্যাগ করার অধিকার নেই’। পড়া শেষ করে পরাধীন দেশের কাজে লাগবেন-এই ছিল তাঁর আদর্শ। অনেক আলাপ-আলোচনার পর মারী রাজি হলেন। ১৮৯৫ সাল থেকে এক সাথে শুরু হলো পথ চলা।

মাদাম কুরী যে সময়ে তাঁর গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন, সেটা ছিল বিজ্ঞানের জগতে এক জটিল কিন্তু উজ্জ্বল সম্ভাবনার কাল। একের পর এক আবিষ্কার। ১৮৯৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম রন্জেন এক্স-রে আবিষ্কার করলেন। এই আবিষ্কার দারুণ আলোড়ন তৈরি করেছিল। পরের বছরেই ১৮৯৬ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল পরীক্ষা করতে করতে দেখলেন, ইউরোনিয়াম ধাতুযুক্ত কোন কোন খনিজ লবণ থেকেও রন্জেনের আবিস্কৃত এক্স-রে বা অজানারশ্মি বেরিয়ে আসে। আর আলট্রাসনোগ্রাফি প্লেটে বা ফিল্মে দাগ ফেলে। বেকেরেল এই ঘটনাকে বা বিকিরণের বৈশিষ্ট্যগুলোর নামকরণ করেছিলেন তেজস্ক্রিয়তা (radio-activity)।

১৮৯৭ সালে প্রথম কন্যা আইরিনের জন্মের তিন মাসের মধ্যেই কঠিন ইস্পাতের চুম্বুকত্ব নিয়ে মানিয়া এক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন। ডক্টরেটের জন্য যে বিষয়টি মানিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হলো বেকেরেল-এর কাজ-ইউরেনিয়ামের যৌগপিন্ড আলোক সংস্পর্শ ছাড়া আপনা থেকেই কয়েকটি অপরিচিত রশ্মি বিকিরণ করে এবং এক্স-রের মতোই পারিপার্শ্বিক বাতাসকে তড়িতাহত করে। মানিয়ার গবেষণার বিষয় হলো – বিকিরণের উৎপত্তি কোথায় এবং বিকিরণের নিয়মই বা কি?

এই গবেষণার জন্য গবেষণাগার হিসাবে পেলেন স্কুল অব ফিজিক্সের একটি পরিত্যক্ত অব্যবহার্য গুদাম ঘর। এই স্কুল অব ফিজিক্সে পিয়ের অধ্যাপনা করতেন এবং মানিয়া তাঁকে গবেষণার কাজে সাহায্য করতেন বিনা পারিশ্রমিকে। এই স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর ঘরটিই রেডিয়াম আবিষ্কারের পীঠস্থান। প্রায় আশিটি মৌল, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের বিভিন্ন যৌগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে মানিয়া লক্ষ্য করলেন ইউরেনিয়াম আকরিক পিচব্লেণ্ড বা Charcolite– এর তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক চিন্তার পর মানিয়া স্থির করলেন পিচব্লেণ্ডে রয়েছে অতি অল্প পরিমাণে কোন অজানা বস্তু। সেই সময় ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এ ধরণের তেজস্ক্রিয় ধাতু সংগ্রহ করা হতো পিচব্লেড নামক আকরিক থেকে। মানিয়া পিচব্লেডের খোঁজে খনির মালিকের কাছে গেলে তারা অবাক হন। বলেন, আবর্জনাগুলো স্বছন্দে দিয়ে দেব, যদি কেউ গাড়ি ভাড়া করে ওগুলো নিয়ে যায়। পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে জমানো টাকা খরচ করে মানিয়া সেগুলো গবেষণাগারে আনলেন। তারপরে সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে দিনের পর দিন ধরে চলল শোধন করার কাজ। বিরাট বিরাট কড়াইতে এসিডে জ্বাল করা হচ্ছে আকরিক। আবার তাকে নিখাদ করা হচ্ছে আরও জ্বাল দিয়ে। ১৮৯৮ সালে একদিন মারিয়া একখন্ড পিচব্লেড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন তার তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম বা থোরিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি। বারবার পরীক্ষায় একই ফল পাওয়া গেল। মারিয়ার মাথায় প্রশ্ন আসল- তাহলে ইউরেনিয়াম বা থোরিয়ামের চেয়েও বেশি তেজক্রিয় কোন অজানা পদার্থ আছে? সেই সময় মানিয়ার কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পিয়ের কুরি চৌম্বকপদার্থের ওপর গবেষণা ত্যাগ করে মানিয়ার সঙ্গে যোগ দিলেন। দু’জনে মিলে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পিচব্লেণ্ডের বিভিন্ন উপাদান পৃথক করা শুরু করলেন। ক্রমাগত পৃথক করতে করতে ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে এক চিমটে কালো গুড়া পেলেন। এর তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের চেয়েও চারগুণ বেশি। দেখা গেল এটা একটা নতুন পদার্থ, যা বিজ্ঞানীদের আগে চেনা ছিল না। কঠোরতম পরিশ্রমের পর যে আদি বস্তুর সন্ধান পেলেন, মানিয়া মাতৃভূমির কথা স্মরণ করে তার নাম দিলেন ‘পোলেনিয়াম’ (১৮৯৮)। কিন্তু মনে হল, পিচব্লেণ্ডের আরও যেন তেজস্ক্রিয়তা রয়ে গেছে। সে বছরের ডিসেম্বরে অধিক সুক্ষ্মতর পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সামান্য পরিমাণে নতুন উপাদান পৃথক করলেন। এটা পোলেনিয়ামের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। ১৯০০ সালে তাঁরা সন্ধান পেলেন রেডিয়ামের। কিন্তু রসায়নবিদ্রা মানলেন না। তাঁরা চাইলেন রেডিয়ামের আনবিক ওজন। জগতের কাছে পোলেনিয়াম ও রেডিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আরও চার বছর প্রাণপাত করলেন তাঁরা এই জীর্ণ চালার নিচে। কোন সরকারী সাহায্য মেলেনি, মেলেনি একটি সুবিধাজনক ল্যাবরেটরী। ফুটো ছাদ বেয়ে জল পড়ে অনেক সময় তাঁদের অনেক কাজ নষ্ট হয়ে যেত। তাদের এই গবেষণা কাজে কয়েক টন পিচব্লেণ্ড তাঁরা উপহার পেয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার সরকারের কাছ থেকে। কেনার পয়সা তো ছিল না। সেই টন টন পদার্থ শোধন করে প্রাণান্তকর পরিবেশে, ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে মানিয়া ছিনিয়ে এনেছিলেন ১ ডেসিগ্রাম রেডিয়াম। আনবিক ওজন নির্ণয় করলেন – ২২৫। সন্দেহগ্রস্তরা মাথা নিচু করল। রেডিয়ামের অনেক গুণাবলীর মধ্যে একটি হলো ক্যান্সারের প্রতিরোধ ক্ষমতা। চিকিৎসা জগতে এর মূল্য অপিরসীম হয়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পক্ষে অর্থলাভের বিরাট সুযোগ নিয়ে এল। অর্থাভাবে জর্জরিত পিয়ের ও মানিয়া এক কথায় সে সুযোগ প্রত্যাখ্যান করলেন। মারীর ভাষায়, “ রেডিয়ামের ব্যবসায়িক সাফল্য আকস্মিক ঘটনামাত্র; এর সুযোগ নেওয়া অত্যন্ত হীন মনোবৃত্তির কাজ ও বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিরোধী।” সুতরাং রেডিয়াম শোধনের যে পন্থা তাঁরা আবিষ্কার করেছিনে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করলেন।

অসংখ্য উপাধি ও পদক জমা হলো পিয়ের ও মারী কুরীর ভান্ডারে। অবশেষে এল ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার। সব দেশের সবচেয়ে পড়ে ফ্রান্স তাঁদের মূল্য দিল। অবশেষে পিয়ের সরবোনের অধ্যাপক পদে উন্নীত হলেন, গবেষণার জন্য দু’খানা ঘর পেলেন, সহকারী পেলেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়নী পদার্থবিদ সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ফ্রান্সে অধ্যাপক পদ পেলেন না শুধু নারী হওয়ার জন্য!

জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-সাধনা-সরলতা ও আদর্শে তারা হয়ে ওঠলেন এক ও অভিন্ন। দুই অনন্যসাধারণ জ্ঞানীর চিন্তাধারা একই খাতে প্রবাহিত হলো। কিন্তু এই প্রবাহ বেশিদূর এগুতে পারল না। ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে রেডিয়ামের ওপর যৌথ গবেষণায় ছেদ পড়ল। এক আকস্মিক পথ দুর্ঘটনায় পিয়ের নিহত হলেন। তবু একা মারী ভগ্ন হৃদয় ও ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ ছাড়লেন না। গবেষণা, মেয়েদের স্কুলে শিক্ষকতা ও দুই কন্যাকে যথোপযুক্ত মানুষ করার কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন। ইতিমধ্যে পিয়েরের শূন্যপদে তাঁকে অভিষিক্ত করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সে সময় ঐ পদে বসার মতো তাঁর চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউই ছিলেন না। পিয়েরের অসমাপ্ত বক্তৃতামালা মারী উপসংহার করলেন অত্যন্ত নিপুনভাবে।

জীবনের এ হেন বিপর্যয়ে নিজেদের তৈরি ১ গ্রাম রেডিয়াম – যা একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি – বিক্রি করে সবরকম খরচের সংস্থান মারী করতে পারতেন, পিয়েরের আজীবন স্বপ্নের ল্যাবরেটরী তৈরি করে রেডিও অ্যাক্টিভিটির নতুন বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, কিংবা দুই মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু দশ লক্ষ ফরাসী স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের এই বস্তুটিকে তিনি দান করলেন ল্যাবরেটরীকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা স্বার্থ নয়, সবার স্বার্থে ল্যাবরেটরীর উন্নতিকেই তিনি অধিক গুরুত্ব দিলেন।

অধ্যাপক, গবেষক, ল্যাবরেটারী পরিচালিক মাদাম কুরী এককভাবে অসম্ভব পরিশ্রম করতে লাগলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম রেডিও-অ্যাক্টিভিটি সম্পর্কে শিক্ষা শুরু করেন। এই উপলক্ষে ১৯১০ সালে প্রকাশ করলেন ‘ট্রিটিজ অন রেডিও-অ্যাক্টিভিটি’ (Treatise on Radio-activity)। ক্রমশ স্বাস্থ্যের অবনতি সত্ত্বেও নতুন গবেষণার কর্মপদ্ধতি স্থির করে নিলেন। তিনি ও তাঁর বহুদিনের পুরনো সহকারী আঁদ্রে দেবির্য়েন (অ্যাক্টিনিয়াম আবিষ্কর্তা) ধাতব রেডিয়াম নিষ্কাষণ করেন। কেউই পরবর্তীকালে এই কাজটি করতে পারেননি। চিকিৎসার প্রয়োজনে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলিকে নির্ভুলভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। এক মিলিগ্রামের সহস্রভাগের এক ভাগকে মেপে নেওয়ার অভূতপূর্ব পন্থা আবিষ্কার করলেন মারী এবং ‘ক্লাসিফিকেশন অব রেডিও এলিমেন্টস’(Classification of Radio -elements) রচনা প্রকাশ করে সাধারণের দ্বারে পৌঁছে দিলেন। এরপর মাদাম কুরির ব্যক্তিগত প্রশংসা সুউচ্চ শিখরে উঠে গেল। সাম্মানিক উপাধি তাঁর টেবিল ভরিয়ে ফেলল। শেষে ফ্রান্স প্রদত্ত ‘লিজিয়ন অব অনার (Legion of honour) তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। নারী ও স্বাধীন মতালম্বী হওয়ার অপরাধে ফ্রান্সের বিজ্ঞান আকাডেমীর সদস্যপদ তিনি পেলেন না। কিন্তু সুইডিশ একাডেমী তাঁকে দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করল রসায়ন শাস্ত্রে। তৎকালে বিজ্ঞানে কেউই এই অমূল্য উপহার দু’বার লাভ করেনি। কিন্তু এত যশ তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই ভালোবাসতেন। আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘সুপ্রসিদ্ধ মনীষীদের মাঝে একমাত্র মারী কুরীর জীবনই যশের প্রভাবমুক্ত বলা যায়।’

১৯১৪ সাল। মাদাম কুরির বহু আকাঙ্খিত পিয়ের কুরির স্মৃতিঘর রেডিয়াম ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও পাস্তুর ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায়। কিন্ত ফ্রান্সে ঘনিয়ে এসেছে দুর্দিন। জার্মানরা অতর্কিতে ফ্রান্স আক্রমণ করেছে। রেডিয়াম ইনস্টিউটের কর্মীরা সব যুদ্ধে গেছে। মাদাম কুরিও নামলেন যুদ্ধক্লিষ্ট মানুষের সেবায়। দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাই দিয়ে দিলেন ত্রান তহবিলে। সোনার মেডেলগুলোও দিতে চেয়েছিলেন।

সেইসময় ফ্রান্সে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য কোন হাসপাতালে এক্সরের বন্দোবস্ত ছিল না। একা মাদাম কুরির অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০০ হাসপাতালে এক্সরের যন্ত্র বসানো হল, এক্স-রে গাড়ির সংখ্যা হলো ২০। সৈন্যবিভাগে এই গাড়িগুলিকে ‘লিটল কুরীস’ নাম দেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে দশ লক্ষ আহত সৈনিকের চিকিৎসার সুব্যস্থা হলো। তিনি নিজে ও আইরিন রেডিওলজির শিক্ষা দিয়ে অনেক সুদক্ষ কর্মী তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক বিপজ্জনক অঞ্চলেও তিনি ঘুরে ঘুরে সৈন্যদের চিকিৎসা দিয়েছেন। মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মাদাম কুরির কাছে এ ছিল অত্যন্ত সাধারণ কাজ।

যুদ্ধের পর ১৯২২ এর ১৫ মে লীগ অব নেশন্স নামে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যে কমিটি গড়ে ওঠে মাদাম কুরি তার সভ্য হিসাবে নির্বাচিত হলেন। মারীর জীবনে এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য ছিল। এরপূর্বে বিভিন্ন দাতব্য সংগঠন, সঙ্ঘ ও প্রতিষ্ঠান তাঁর নাম সভ্য তালিকায় রাখার চেষ্টা করেছে। মাদাম কুরী তাতে একবারও রাজী হন। যেখানে কোন কাজের কাজ করতে পারবেন না সেখানে শুধু সভ্য হয়ে থাকতে চাননি। লীগ অব নেশন্স -এর সভ্য হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে দিলেন। দুনিয়ায় “ বৈজ্ঞানিক কাজের রাজ্যে অরাজকতার” বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন। তিনি শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন করতে চাইলেন। যাতে পৃথিবীর সবদেশে একই রকমের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়, বৈজ্ঞানিক বই ও আবিষ্কারের যাতে পুরো তালিকা তৈরি করা হয় তার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ নিলেন। তিনি মনে করতেন, অসামান্য প্রতিভাবান কোন বৈজ্ঞানিককে কোনো দেশেই টাকার অভাবে যেন পিছিয়ে যেতে না হয়। এক রিপোর্টে তিনি প্রশ্ন করেন, সমাজ কি চায়? বৈজ্ঞানিক কীর্তি-কলাপের উন্নতি-সাধনকে সমর্থন করাই কি তাঁর কর্তব্য নয়? তা যদি হয়, তবে এ বিষয়ে যেসব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিসর্জন দেবার মতো সম্পদ কি সমাজের আছে? বরং আমার মনে হয়, প্রকৃত বিজ্ঞান সাধনার জন্য যে জাতীয় চারিত্রিক গুণাবলীর প্রয়োজন, তা এতই অমূল্য ও দুষ্পাপ্য সম্পদ যে, তাকে হারানো শুধু অন্যায় নয়, অচিন্তনীয়; সেদিকে সযতœ দৃষ্টি রেখে তাকে ফলবতী হবার সকল সুযোগ দেয়া কর্তব্য’। তিনি আরো বলেন, ‘বিজ্ঞানের অপূর্ব সৌন্দর্যে যাদের আস্থা আছে, আমি তাদেরই একজন’। অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন এমন এক পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান হবে বাধাহীন,বিরাজ করবে স্বাধীনতা আর শান্তি।

১৯২২ সালে চিকিৎসা-আকাদেমির পঁয়ত্রিশ সভ্য তাঁদের সহকর্মীদের কাছে নিম্নোলিখিত আবেদন পাঠালেন: ‘আকাদেমির নিম্নোক্ত সভ্যরা মনে করেন যে, রেডিয়ম তথা কুরী থেরাপি-খ্যাত চিকিৎসার অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কারের পুরস্কার স্বরূপ মাদাম কুরীকে স্বাধীন সহকর্মী সভ্য পদে সম্মানিত করা কর্তব্য।’ এটি ছিল যুগান্তরকারী একটি দলিল। এর দ্বারা বিজ্ঞান আকাদেমীতে সভ্যপদ প্রার্থীদের চিরাচরিত নির্বাচনের রীতি লঙ্ঘন করে তাকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আহ্বান করা হলো। চৌষট্টি জন সভ্য সোৎসাহে এই দলিলে স্বাক্ষর দিলেন। এইভাবে আকাদেমির বিজ্ঞান-বিভাগের ভাইদের যথেষ্ট শিক্ষা দেয়া হলো। শূন্য আসনে মাদাম কুরীর অধিকার জ্ঞানে আর কেউ প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন না। ১৯২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কার্য শেষ হলো। আকাদেমির মঁসিয়ে চশার্দ বক্তৃতামঞ্চ থেকে মাদাম কুরীকে সম্বোধন করলেন: আপনার মধ্যে যে বিরাট বৈজ্ঞানিক, যে মহীয়সী নারী, কর্মজীবনে, বিজ্ঞানসাধনায়, কি যুদ্ধে, কি শান্তিতে সর্বদাই স্বীয় কর্তব্যের অনেক বেশির কাজ করেছেন, তাকে আমাদের সম্মাান জানাই। এখানে আপনার উপস্থিতিতে নামের গৌরবের সঙ্গে নৈতিক উৎকর্ষের উদাহরণ স্বরূপ আপনাকে আমরা পেয়েছি। আমাদের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনার আগমনে আমরা গর্বিত। ফ্রান্সের আকাদেমিতে নারীর এই প্রথম পদক্ষেপ, কিন্তু এমন উপযুক্ত মহৎ নারী আর কে দেখেছে?’

মাদাম কুরী তিন-চারবার পোল্যান্ড ঘুরে আসেন। স্বাধীন মাতৃভূমিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ওর্য়াস’য় একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট খোলার পরিকল্পনা করেন। দরিদ্র পোল্যান্ডে শিল্পীর অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থাভাব। আর মারীর হাতেও সব বন্দোবস্ত করা বা যথেষ্ট টাকা যোগাড় করার সময় ছিল না। প্রথম তাঁর এই ডাকে সাড়া দিলেন বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত ও উৎসাহী, কর্মঠ বোন ব্রনিয়া। সারা গ্রামাঞ্চলে মারীর মখের ছবি দেয়া টিকেট আঁটা প্রাচীর পত্র ছেয়ে গেল। অর্থ সাহায্য-না, বরং ইট দানের ধুম পড়ে গেল; মারী শক্লোদোভস্কা ইনস্টিটিউটের জন্য ইট কিনুন!” হাজার হাজার পোস্টকার্ডে বৈজ্ঞানিকের অনুরোধ ঘোষিত হলো: আমার একান্ত ইচ্ছা যে, ওয়ারস’য় রেডিয়ম ইনস্টিটিউট তৈরি হয়–।” সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট সাড়া পাওয়া গেল। অবশেষে ১৯২৫ সালে মারী এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তি স্থাপনের জন্য ওয়ারসে আসলেন। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৯ মে মারীর উপস্থিতিতে ওয়ারসে রেডিয়ম ইনস্টিটিউটের দ্বার উম্মোচন হলো। এটাই ছিল ওয়ারসে তাঁর শেষ আসা।

চল্লিশ বছর বিজ্ঞান সাধনার ফলে যে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি যেন নিজেই রেডিয়য়ামের জীবন্ত লাইব্রেরী। বিজ্ঞান সবার-এই মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ মাদাম কুরি তাই প্রিয় রেডিয়ামের সর্বসত্ত্ব ত্যাগ করলেন। কিন্তু রেডিয়াম তার অধিকার ছাড়তে রাজি হয়নি। সারাজীবন রেডিয়াম নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাঁর হাত দু’টিই শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়নি, দেহের অভ্যন্তরে রক্তের কোষগুলিও আক্রান্ত হয়েছিল। রক্তহীন অবস্থায় ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ডাক্তারের ভাষায়, ‘মাদাম কুরী ও পিয়ের কুরী যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থের সন্ধান আজীবন করে গেছেন, মাদাম কুরীকে তার শিকার বলা যেতে পারে।’ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পরম আদরের রেডিয়ামের ওপর তাঁর স্নেহদৃষ্টি বর্ষিত হতো। মারী বলতেন, ‘কারুর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের কাজ নয়। রেডিয়াম মৌলিক পদার্থ মাত্র। তার ওপর সবার সমান অধিকার।’

১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই অতি শান্ত, অনাড়ম্বর পরিবেশে ফুলের মাঝে তাঁকে সমাধিস্থ করা হলো, ঠিক যেমনটি তিনি চাইতেন। ইভ কুরীর ভাষায়, সব কিছু নির্মল, শুভ্র; মস্ত কপাল ছড়িয়ে তুষার শুভ্র কেশ; শান্তিতে গাম্ভীর্যে সে যেন এক বীর যোদ্ধার মুখ: সেই মুহুর্তে পৃথিবীর মধ্যে পরমতম সুন্দরতম, পবিত্রতম যেন সে-রূপ!

তথ্যসূত্র:

মাদাম কুরী: ইভ কুরী
স্বাস্থ্যবীক্ষণ -অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *