জুলিয়াস ফুচিক : এক আমৃত্যু সংগ্রামী বীর

তাহা ইয়াসিন

জুলিয়াস ফুচিকের জন্ম ১৯০৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় । চল্লিশ বছর বয়সে তাঁকে নাৎসি বাহিনী ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট প্রাণদন্ড দেয়। প্রাণদন্ডের আগে বন্দীশালায় যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন টুকরো কাগজে কিছু লিখে গিয়েছিলেন। পরে সেসব বই আকারে বের করেন তাঁর স্ত্রী অগাস্তিনা ফুচিক। তিনিও ছিলেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে । হিটলার-জার্মানির পরাজয়ের পর তিনি মুক্তি পান। দেশে ফিরে হাজার হাজার মানুষ যেমন প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকেন তিনিও তেমনি খুঁজে ফেরেন তাঁর স্বামীকে। জানতে পারেন দন্ডাদেশের চৌদ্দ দিন পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এও জানতে পারেন যে, প্রাহার প্যানক্রাটস বন্দীশালায় কোলিনস্কী নামক এক কারারক্ষীর দেয়া কাগজে জুলিয়াস ফুচিক কিছু লিখেছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই স্ত্রী অগাস্তিনা ফুচিক বিভিন্নজনকে লেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু চিঠি সংগ্রহ করেন। সেগুলোই পরে ‘লেটার ফ্রম গ্যালো’ নামে প্রকাশিত হয়। বাংলায় এর নাম দেয়া হয় ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’।

অনেক ভাষায় অনূদিত হওয়া বইটির ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে কলকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা.লিঃ। এই অনুবাদটি অনেকের পড়া। জুলিয়াস ফুচিকের মতো বিপ্লবী বলতে গেলে আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীর শহিদরাই এখন পর্যন্ত বাংলায় জন্ম নেয়া সবচেয়ে সাহসী ও বিপ্লবী। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কাহিনী আমরা সকলে জানি। তাঁর লেখা চিঠিটিও অনেকেই পড়ে থাকবেন।

জুলিয়াস ফুচিক স্ত্রীকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন তার একটি ছিল এরকম-

‘প্রিয় গাস্তিনা আমার,

এইমাত্র তোমাকে চিঠি লেখার অনুমতি পেয়েই লিখতে বসেছি। লিবা লিখেছে তুমি ডেরা বদলেছ। এ কথা কি তুমি ভেবে দেখেছ, প্রিয়তমা আমার – আমরা পরস্পর থেকে দূরে নই? ভোরবেলায় যদি তুমি টেরজিন থেকে পায়ে হেঁটে উত্তর দিকে রওনা হও, বাউৎসেন থেকে আমি রওনা হই দক্ষিনে – তাহলে সন্ধ্যে নাগাদ আমাদের দেখা হবে। কাছাকাছি এসে দুজনে কী ছোটাই না ছুটব। আমরা এমন সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেখানে আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়ানো। তুমি আছো টেরজিনে যেখানে আমার কাকা বিরাট খ্যাতিলাভ করেছিলেন। আর আমাকে নিয়ে যাবে ওরা বার্লিনে – যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আমি অবশ্য মনে করি না, ফুচিক পরিবারের সবাইকে বার্লিনে মরতে হবে। লিবা হয়ত তোমাকে লিখেছে – একা আমি একটা সেলে আছি; বোতাম বানাতে হচ্ছে আমাকে। আমার সেলের নিচের দিকে এককোণে একটা ছোট্ট মাকড়সা আছে আর বাইরে আমার জানালার ওপর একজোড়া রবিন পাখি বেশ আরামে নীড় বেঁধেছে। কাছে, কত কাছে আমি তাদের শিশুর মতো মিষ্টি কাকলি শুনি। তারা তাদের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে, দাম্পত্য জীবনের কতই না তাদের দুর্ভাবনা ছিল। ওদের দেখি আর তোমার কথা মনে পড়ে যায়। সেই যে তুমি মানুষের মুখের কথায় আমাকে পাখির ভাষা বুঝিয়ে দিতে। প্রিয়তমা আমার প্রহরে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলি। সেইদিনের জন্য আমি সকাতরে প্রতীক্ষা করে আছি, যেদিন মুখোমুখি বসে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব। তখন কত কথা জমে থাকবে দু’জনে দু’জনকে বলবার। প্রিয়তমা আমার, সাহসে বুক বাঁধো, শক্ত হও। তোমাদের সবাইকে আমার চুম্বন আর আলিঙ্গন। যতদিন না আবার দেখা হয়।

তোমাদের জুলা।

বাউৎসেন, ৮ আগস্ট, ১৯৪৩

ছবি : জুলিয়াস ফুচিক

ফুচিকের লেখা বইটি আমাদের আন্দোলিত করে। এই উপমহাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো সংগ্রামের জন্য কারাগারে বড় বড় বিপ্লবীদের জীবনের পরিণতি এরকমটা কম হয়েছে । ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল সেকারণে কমরেড মুজফফর আহমদসহ অনেকে বছরের পর জেল খেটেছেন কিন্তু ফাঁসীতে মুত্যু হয়নি। হিটলারের নাৎসী বাহিনী যেভাবে ফাঁসী দিয়ে বিপ্লবীদের হত্যা করেছে ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলনকারীদেরই সেটা করা হলেও কমিউনিস্ট পাটির সদস্যদের তেমনটা করা হয়েছে কম।

১৯২১ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ফুচিক এর সাথে যুক্ত হয়ে যান। পরে তিনি ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক। পার্টির কাজের অংশ হিসেবে লিখেছেন, পত্রিকা বের করেছেন এবং পড়াশোনা করতেন। অল্প বয়স থেকেই লিখতেন। মাধ্যমিকে পড়ার বয়সেই তিনি ‘দাস’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করতেন। নিয়মিত লিখতেন চেকোস্লোভাকিয়া কমিউনিস্ট পাটি প্রকাশিত পত্রিকায়। চেক রিপাবলিকের রাজধানীর প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য, মিউজিক ও আর্টের উপর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে তিনি কমিউনিস্ট পাটি পরিচালিতে পত্রিকা ‘রুদ প্রাভো’তে যোগ দেন। অন্যান্য পত্রিকায়ও নিয়মিত লেখেন। ১৯৩৪ সালে গ্রেফতার হন চেক পুলিশের হাতে এবং আট মাসের কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। এরপর ১৯৩৬ সাল অবধি চেক কমিউনিস্ট পাটির প্রতিনিধি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে অতিবাহিত করেন। ১৯৩৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর সরকারের অগোচরে পার্টির কার্যক্রম চলতে থাকে। জুলিয়াস ফুচিকও নিষিদ্ধ ঘোষিত আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া কমিউনিস্ট পার্টির কাজ চালিয়ে যান।

১৯৪০ সালে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে। জুলিয়াস ফুচিক পার্টির কাজ চালিয়ে যান এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কমিউনিস্ট পাটির পত্রিকা ‘রুদ প্রাভো’ আবার বের করার উদ্যোগ নেন। ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী তাঁকেসহ আরো ৫/৬ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে । ১৯৪৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তাঁকে প্রাণদন্ড দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *