পালঙ্ক
-ফকরুল ইসলাম
‘পালঙ্ক খানা দক্ষিনের দুটি বড় বড় জানালা ঘেঁষে এখনো পাতা রয়েছে। গদিটাকে পুরু চট দিয়ে ভালো করে ঢেকে রেখেছেন রাজমোহন। রোজ একবার করে এসে দেখেন, উঁই ইঁদুর কাটল কিনা। রোজ একবার করে কাঁধের গামছা দিয়ে পালঙ্কের ধুলো মোছেন। পুব দিকের বেড়ায় সুরেন আর অসীমার বাঁধানো ফটো। উত্তর দিকে ধানের গোলা আর স্তুপীকৃত শুকনো সাদা পাট। ‘
রাজমোহন পালঙ্কটি দেখে রাখে আর নাতি-নাতনীকে নিয়ে সুরেন এবং অসীমা সেটার উপর শুয়ে আছে এমনি ভাবে। ফটোখানা তার মনে ভাবনার বাস্তবরূপ দানে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
সুরেন রাজমোহনের ছেলে আর অসীমা পুত্রবধু। দেশভাগের পর ছেলে সুরেন স্ত্রী-সন্তানসহ ইন্ডিয়ায় চলে যায়। রাজমোহনের চার নাতি-নাতনী কানু,টেনু, রীণা, মীনা। ছেলে, পুত্রবধু, নাতি-নাতনীকে ছেড়ে রাজমোহন একাই চাকর-ঝি সহ দীর্ঘকালের অভ্যস্ত জীবন কাটান পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশে।
বাড়ির গাছগাছালি, আবাদের ফসল, ঘরবাড়ি, চাকর-ঝি এসবের প্রেমে রাজমোহন দেশত্যাগ করতে পারেননি। ওকথা ভাবতেও পারেন না। কিন্তু একা, বড় নিঃস্ব তার জীবন। তারপরেও মাতৃভূমি ছেড়ে তার পক্ষে ভেগে যাওয়া সম্ভব হয়নি । তিনি যেতে পারেন নি । চিরদিন চাকর-ঝিকে যেমন কাজকর্মের জন্য তাড়া দিতেন, বকঝকা করতেন, এখনও তাই নিয়ে থাকেন।
রাজমোহনকে নিয়মিত দুধ দিয়ে যায় মকবুল । সবার মতো মকবুলও রাজমোহনকে ডাকে ধলাকর্তা বলে । সে মাঝে মাঝে এটাসেটা ফাইফরমাসও করে । বেলেঘাটা থেকে সুরেন চিঠি পাঠিয়েছে । সেই চিঠি পোস্ট-অফিস থেকে নিয়ে আসার সময় ভিজে ফেলে মকবুল । তাই নিয়ে তাকে বকা দেয় রাজমোহন । বকা দিলেও মকবুলকে তামাক খাওয়ার কথা বলতে ভোলেন না তিনি । মুসলমানদের জন্য রাখা আলাদা হুকোয় তাই মকবুলকে তামাক খেয়ে যেতে বলেন।
চিঠি খুলে পড়তে বসেন রাজমোহন । চিঠি লিখেছে অসীমা। তার সুন্দর হাতের লেখা, চিঠির সম্বোধন এসবের প্রশংসা চাকরদের ডেকে শোনান ।
চিঠিতে অসীমা তার বাবার দেয়া পালঙ্কখানা বিক্রি করে টাকা পাঠানোর কথা জানিয়েছে। তার নাতি-নাতনী শ্যাঁৎসেঁতে ঘরে থাকার কারণে সবসময় অসুখ-বিসুখে ভোগে। তার ছেলে খাট-তক্তপোষ কেনার টাকা জোগাড় করতে পারছে না। তাছাড়া পালঙ্কখানা অব্যবহৃত থাকলে একসময় নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ফসলের মৌসুমে মুসলমানদের হাতে টাকা-পয়সা আছে, বিক্রি করে টাকা পাঠালে তারা খাট-তক্তপোষ কিনতে পারবে।
ছেলে সুরেন আলাদা চিঠি না লিখে স্ত্রীর চিঠির এক কোণায় সুপারিশ করে,’ আমার মনে হয় অসীমার প্রস্তাবে আপনার কোন আপত্তি থাকতে পারে না। ‘
চিঠি পড়ে রাজমোহন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। পালঙ্কটি তার কত প্রিয় তা জগতের কেউ জানে না। তারপরও রাগের মাথায় মকবুলকে সেটা বাড়ি থেকে সরাতে বলে। মকবুল গরীব। সে বাঁশের শুকনো চোঙায় পাট বেচে, গাইয়ের দুধ বেচে একটি একটি করে সঞ্চয় করেছে কিছু টাকা ।
তার সেই টাকায় ঘর সারানোর কথা ছিল, অথবা গাই কেনার, গয়না কেনার কথা ছিল। কিন্তু জমানো ওই ৫০ টাকায় পালঙ্কখানা কিনে আনে। যদিও রাজমোহন রাগের বশীভূত হয়ে তা বিক্রির কথা বলে। এছাড়া পালঙ্কের বাজার দামও আড়াইশোর কম হবে না। রাজমোহন রাগের মাথায় বললেও ; সেকথা ধরেই মকবুল সেটা নিয়ে আসে। মকবুলের এটি রাখারই ঘর নেই। ছোট শনের ঘরে পালঙ্ক রেখে তার নীচে স্ত্রী ফাতেমার হাড়ি-পাতিল, আসবাবপত্র রাখে।
নিজের জমানো ৫০ টাকা রাজমোহনকে দিয়ে পালঙ্ক আনার পর থেকে তার হাঁড়িতে আর চাল পড়েনা। রাজমোহন পরদিনই ৫ টাকা বেশি দিয়ে ফেরত চাইলে মকবুল রাজী হয়না। প্রচন্ড অভাবে মকবুল সন্তানসহ না খেয়ে মর মর অবস্থায়ও ২/৩ গুন মূল্যের প্রস্তাবেও পালঙ্ক হাতছাড়া করে না । এরমধ্যে প্রায় প্রতিদিনই রাজমোহন নানা অজুহাতে মকবুলের বাড়ি এসে এদিক-ওদিক দিয়ে আড়চোখে পালঙ্কটি দেখে যায়।
রাজমোহন অসুস্থু হওয়ার পরও কাঁপতে কাঁপতে একদিন দেখতে আসে পালঙ্কটি। তার অবস্থা দেখে মকবুল পালঙ্কের ওপর থেকে শুয়ে থাকা ছেলেমেয়ে সরিয়ে নিয়ে পালঙ্কটি রাজমোহনকে ফিরিয়ে দিতে চায়। রাজমোহন নিতে রাজী হয়না। তিনি বলেন,
‘ এতদিন চুরি কইরা কইরা তোর ঘরের পালং আমি দেইখা গেছি মকবুল। কিন্তু খালি পালংই দেখেছি। আইজ আর আমার পালং খালি না। আইজ আর আমার চৌদোলা খালি না। আইজ চৌদোলার ওপর আরো দুইজনরে দেখলাম- দেখলাম আমার রাধাগোবিন্দরে আমারে পৌঁছাইয়া দিয়ে আয় মকবুল।
স্ত্রীর হাত থেকে কেরোসিনের ডিবাটা তুলে নিতে নিতে মকবুল বলল,’ চলেন ধলাকর্তা। ‘
রাজমোহন অসুস্থু হওয়ার পর তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে বৈষয়িক জিনিশের মোহ তুচ্ছ হয়ে যায় এবং নিজের নাতি-নাতনীর প্রতিচ্ছায়া দেখতে পান মকবুলের ছেলেমেয়ের মাঝে। সারাজীবনের সঞ্চিত দেশপ্রেম, সহায়-সম্পত্তি আপন অস্তিত্বের অনুপুস্থিতে ক্ষণিকের জন্য নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে ; এমন সময় একান্ত কাউকে হয়তো মানুষ খুঁজে ফেরে যেটির সন্ধান পান রাজমোহন মকবুলের দুটি দেবতুল্য সন্তানের মাঝে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “রস” গল্পটি অনেকেরই পড়া থাকতে পারে। মানুষের সুক্ষ্মতম অনুভূতির শৈল্পিক রূপায়নে তিনি বাংলা ছোটগল্পকার হিসেবে যেমন অনন্য ; এ গল্পটিতে তাঁর সে দক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট।
আরও পড়ুন …
কেরালায় নারীর স্তন ঢাকলে দিতে হত কর