একজন ধর্ষক এর পারিবারিক ও সামাজিক আশ্রয়
-মাধবী লতা
গাইতে গাইতে গায়েন- কথাটা সবাই জানেন, মানেন তো? যদি মানেন তাহলে লেখার পরবর্তী অংশ আপনার জন্য।
বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে আশংকাজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে (প্রচুর ধর্ষণ রিপোর্টের বাইরে)। অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, আপনি কি জানেন, ধর্ষণের এই বাম্পার ফলনের পেছনে আপনারও অবদান আছে? অবাক লাগছে? কত শিশু তার কাছেপিঠের পরিচিত মানুষ দ্বারা শৈশবে-কৈশোরে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে তার হিসেব নেই।
আপনার পরিবারেই কোনো শিশু এমন নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকলে আপনি কি তার প্রতিকার করেছেন? আত্মীয়তার-বন্ধুত্বের সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন? শাস্তি নিশ্চিত করেছেন? নাকি শিশুটির মুখ বন্ধ করে দিয়ে শান্তি বজায় রেখেছেন? আপনার মাথায় গেঁথে আছে, যে শিশুটি যৌন নিগ্রহের শিকার, সব লজ্জা তার। তাই লোকলজ্জার ভয়ে শিশুটিকে অন্যায় সহ্য করতে শেখান।
বাকি জীবনে সে আর মুখ খোলার সাহস পায় না। যে জানোয়ারটিকে আপনি লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা আত্মীয়-বন্ধু বলে ছেড়ে দিলেন, তার সাহস বাড়ল। সে বুঝে নিল, মেয়েদের গায়ে হাত দিলে কিছু হয় না। কেউ কিছুই বলে না। শাস্তি তো বহু দূরের কথা।
এই দেশে বাস করেন অথচ তার সামনে কেউ কখনো কোনো মেয়েকে হয়রানি করে নি, শরীর নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেনি, কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করেনি, ইভ টিজিং করেনি এমন মানুষ নেই। নিশ্চয়ই আপনিও এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছেন।
কখনো কোনো ইভ টিজারকে দুটো কথা শুনিয়েছেন? আইনের আওতায় এনেছেন? নাকি টিজিং এর শিকার নারীর পোশাকের পোস্টমর্টেম করেছেন। একা বের হয়েছে কেন কিংবা সন্ধ্যার পর বাইরে কী- জাতীয় ভাবনায় ইভ টিজারকে সমর্থন দিয়ে গেছেন? কখনো কি টিজিংএর শিকার নারী প্রতিবাদী হয়ে উঠলে তাকে বলেন নি, মেয়েদের এত কথা বলা মানায় না?
থাক, চুপ করেন। কিংবা অন্য কেউ এ কথা বললে তাকে মৌখিক বা নীরব সমর্থন করেননি? যদি প্রতিবাদ না করে থাকেন, প্রতিকার না করে থাকেন, যদি মিষ্টি খোলা থাকলে পিঁপড়া ধরবেই নীতি মেনে থাকেন, যদি উল্টো নারীকেই দোষারোপ করে থাকেন, তাহলে আপনি একজন সম্ভাব্য ধর্ষকের জন্ম দিলেন। সেই ইভটিজার আপনার কাছ থেকে এই বার্তাই পায়- নারীর একা চলা মানা, রাতে বের হওয়া মানা, কালো ঢোলা বোরকা ছাড়া অন্য কিছু পরা মানা।
যদি সে এসবের একটাও করে তবে তাকে নিগ্রহ করা যেতে পারে। এমনকি পাবলিকের সামনেও করা যেতে পারে। তাতে ভয়ের কিছু নেই, বরং অসংখ্য গুণগ্রাহী পাওয়া যাবে আশেপাশে। হয়তো আপনার সহপাঠী, বন্ধু, সহকর্মী আপনারই সামনে রসিয়ে রসিয়ে কোন নারীর দেহবল্লরীর বর্ণনা দিয়েছেন। নারীকে খাসা, জোস, সিরাম মাল ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ধরে নিলাম, আপনি নিতান্তই সজ্জন ব্যক্তি। এসব ভাষা আপনি কস্মিনকালেও ব্যবহার করেন না। কিন্তু প্রতিবাদ? প্রতিবাদ করেছেন কখনো? এই অশ্লীলভাষীকে ত্যাগ করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে সুযোগের অভাবে এখনও ধর্ষণ করতে না পারা এই সম্ভাব্য ধর্ষকের আপনিও একজন পৃষ্ঠপোষক।
আপনার পরিবারে কখনো দেখেছেন, মেয়েদের আটকে রেখে ছেলেদের ধর্মের ষাঁড়ের মত ঘুরে বেড়াতে দিতে? মেয়েরা এটা বলতে পারবে না, সেটা পরতে পারবে না, স্কুলে-কলেজে পিকনিকে যেতে পারবে না, বন্ধুর জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে যেতে পারবে না। হোস্টেলে থেকে বা দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা! নৈব নৈব চ! এর মধ্যে কোন কাজটি আপনার পরিবারের ছেলে সন্তানের জন্য নিষিদ্ধ? আপনিই আপনার সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছেন।
ছেলেমেয়েকে দুটো আলাদা প্রাণির মতো ট্রিট করেছেন। আপনার মেয়েটিকে নিয়মনীতির যত বেড়াজালে আবদ্ধ করেছেন, তার সিকিভাগও যদি ছেলেকে নৈতিক শিক্ষা দিতেন তাহলেও সে নারীকে সম্মান করতে শিখত। একটি ছেলে যদি নিজের ঘরে মেয়েদের সমান অধিকার পেতে দেখত তবে সে মেয়েদের মানুষ ভাবতে শিখত। নারীকে সম্মান করতে না পারা, নারীকে মানুষ ভাবতে না পারা মানুষগুলোই একদিন ইভটিজার হয়, ধর্ষক হয়।
আপনি আপনার ঘরে একজন ধর্ষককে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন।
ধর্ষকের জীবন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে সে রাতারাতি ধর্ষক হয়ে ওঠেনি। একদিনেই সে ধর্ষণের সাহস অর্জন করেনি। প্রথমত, সে নারীকে মানুষ হিসেবেই ভাবতে পারে না। নারীদেহ একটি জীবন্ত ভোগ্যপণ্য তার কাছে। তাই তার কাছে দুই মাসের শিশু কিংবা নব্বই বছরের বৃদ্ধা সবই এক। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের আগে সে কখনো নারীনিগ্রহ করে থাকলেও অনায়াসেই পার পেয়ে গেছে।
কারণ প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ কেউই করে না। নারীর প্রতি সামান্যতম বৈষম্যের যারা প্রতিবাদ করেননি, করেননি প্রতিরোধ, যারা পরাতে চেয়েছেন কেবল নারীর পায়েই শেকল, তারা কেউই আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া একটিও ধর্ষণের দায় এড়াতে পারেন না।
আমরা, আমাদের সমাজ সবাই মিলে একেকজন ধর্ষক তৈরি করি, ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষকতা করি, ধর্ষিতার পোশাক আর চরিত্রের পোস্টমর্টেম করে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করি। ধর্ষককে ছাড় দিয়ে জন্ম দেই আরও নতুন নতুন ধর্ষকের।