ইতিহাসের সাক্ষী কামাল লোহানী চলে গেলেন —— গোলাম রহমান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী ২০ জুন ২০২০ এ ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । বয়সের কারণেই তিনি অনেক দিন ধরেই ফুসফুস ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর সাথে এক অনুষ্ঠানে আমার দেখা এবং কথা হয়েছিল । তখনই দেখেছি তিনি ভালোভাবে কিছু পড়তে পারছিলেন না । চোখের সমস্যা তাঁর আগে থেকেই ছিল । তখন তাকে দেখে খুব একটা অসুস্থু মনে হয়নি। তাঁর প্রখর ব্যক্তিস্বত্ত্বা তখনো জাগ্রত । তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষীই কেবল নন সেই ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। তাঁর জীবন ইতিহাসই সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস। যেকোন রাজনীতি সচেতন, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এবং নির্মোহ-নিরপেক্ষ গবেষক কামাল লোহানীর জীবন ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করলে আমাদের প্রকৃত অবস্থার গতিপ্রকৃতি তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। এখানে আমি তাঁর সংক্ষিপ্ত এবং সরল রৈখিক বায়োগ্রাফি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

তাঁর পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে। ৬-৭ বছর বয়সে মাতৃহারা হন তিনি। এদিক থেকে বিড়ম্বিত হৃদয়াহত মানুষ ছিলেন তিনি। তবুও তিনি খাদহীন জীবন বয়ে চলেছেন আজীবন। ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক এবং এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর প্রচলিত শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায় শুরু হয় তাঁর জীবন সংগ্রাম ।

১৯৫৩ সালে পাবনার স্টেডিয়ামে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠানে নুরুল আমিনের আগমন উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ করে। সেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকারীদের একজন ছিলেন কামাল লোহানী। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের কারণে পাবনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ , এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হলে বাদ পড়েননি কামাল লোহানীও। সেটাই তাঁর প্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া। এরপর জীবনে তিনি একাধিকবার নানান প্রেক্ষিতে জেল খাটেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২৯ মে ৯২-(ক) ধারা জারির মাধ্যমে ‘গভর্নরের শাসন’ চালু করে। এরপর শুরু হয় গণগ্রেফতার। কামাল লোহানী যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় তিনিও গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তি লাভ করেন।

এরপর তিনি চলে আসেন ঢাকায় । সাংবাদিকতার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর জীবনের পথ চলা । ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায়। এ বছরই তিনি মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি তথ ন্যাপে যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে তিনি আত্মগোপনে যান।

একসময় নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মে তাঁর । বুলবুল ললিতকলা একাডেমির হয়ে তিনি নৃত্যগুরু জি এ মান্নান প্রযোজিত ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ এ অংশ নেন । পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশেও তিনি যান।
ছায়ানট, উদীচী, ক্রান্তিসহ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ষাটের দশক থেকে এসব সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নানাভাবে যুক্ত থাকেন তিনি। আমাদের রুটিরুজি সংগ্রহে জীবন ওষ্টাগত অথচ এর বাইরেও তিনি সর্বদা প্রমিথিউসের মতো ন্যায়ের পক্ষে কাজ করে গেছেন। বেঁচে থাকার জন্য একের পর এক কাজে যোগদান অব্যাহতি অন্যদিকে দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে লড়াই-সংগ্রাম ; একেবারে হাতের উপর জীবন নিয়ে বাঁচা । বাঁচলে বাঁচার মতো নইলে মৃত্যু সন্মূখপানে তাকিয়ে সৈনিকের মতো এক জীবন। তিনি এ জীবন উপভোগ করেছিলেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।

১৯৬২ সালে কিছদিন জেল খেটে বের হওয়ার পর তিনি ‘ ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধের আগের এক দশক পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং বাংলাদেশের মানুষের পাকিস্তানি বিরোধী মনন গঠনে ‘ছায়ানট’ এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। পাকিস্তান সরকার রেডিওতে রবীন্দ্র-সংগীত প্রচার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা দেবে এমন সংবাদ প্রচারিত হলে এর বিরুদ্ধে তীব্রপ্রতিবাদ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তান সরকার এই দুরভিসন্ধি থেকে সরে আসে। এই আন্দোলনকে এককভাবে সংগঠিত করে ‘ছায়ানট ‘। ছায়ানটের যাত্রা এবং বিকাশ স্বাধীনতার পূর্বের দশকে। ওই উত্তাল সময়ে অন্যান্য আরো অনেক গুণীজনদের মধ্যে কামাল লোহানীও ছিলেন ‘ছায়ানট’ এর কর্ণধার। সাড়ে চার বছর তিনি ছায়ানটের দায়িত্ব পালন করেন।

‘ ছায়ানট ‘ এর দায়িত্বপালন শেষ হলে তিনি ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সংগঠনটির উদ্বোধন হয় । সেখানে আয়োজন করেন গণসংগীতের অনুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’। এ ছাড়া মঞ্চস্থ করা হয় নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’। এটি তিনি পরিচালনা করেন এবং অভিনয়ও করেন। পরে নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’ তে বিবেকের ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বেতারের দায়িত্বভার গ্রহন করেন । ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ নামে একটি নতুন পত্রিকায় যোগ দিয়ে আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবার্তা’, এরপর ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করেন।

তিনি ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’নামক একটি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এবং ১৯৭৮ সালে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৮১ সালে ‘দৈনিক বার্তা’ছেড়ে ‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’ এ যোগ দেন। ১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রায় দেড় বছর কাজ করার পর সরকারের সাথে মতানৈক্য দেখা দিলে তিনি পূর্বের চাকরি প্রেস ইনস্টিটিউটেই ফিরে যান। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদপত্র এবং সংবাদ ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টানগুলোতে কেটেছে তাঁর পুরোটা জীবন। ফলে জীবনব্যাপী তিনি ছিলেন একজন লড়াকু সৈনিক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অসংগঠিত সাংবাদিক ইউনিয়নকে সংগঠিত করে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও কামাল লোহানী গণ শিল্পী সংস্থা নামে একটি সাংস্কৃতিক জোট দ্বারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করার শক্তি যোগান।

উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি । উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে এবং ছায়ানটের সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *