সফোক্লিসের ইডিপাস

সোফোক্লিসের “ইডিপাস”

Share

শাহিনুল ইসলাম খান শান্ত

বিশ্বসাহিত্য বিচারে সর্বকালের সেরা ট্র্যাজেডি ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস রচিত ‘রাজা ইডিপাস’। এরিস্টটল এই নাটককে ট্র্যাজেডির শ্রেষ্ঠ নমুনা হিসেবে গণ্য করতেন। তিনি এতে দেখতে পেয়েছিলেন নির্ভুল প্লট ও মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা এবং তার সাফল্যজনক চিত্রায়ণ। তিনি এই ‘ রাজা ইডিপাস’ নাটক থেকেই ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ণয় করেছিলেন।

সোফোক্লিসের জীবন সম্পর্কে তথ্য খুবই কম পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন খ্রীস্টপূর্ব ৪৯০ সালে ম্যারাথন যুদ্ধের কয়েক বছর আগে আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৪৯৬ সাল নাগাদ মধ্য গ্রীসের অ্যাটিকার অন্তর্গত হিপ্পিওস কোলোেনাসে এক গ্রামীন ডেমে সম্প্রদায়ে ধনী পরিবারে সোফোক্লিসের জন্ম হয়। তাঁর পিতা সোফিলাস (Sophillus) সম্ভবত একজন বর্ম প্রস্তুতকারী ছিলেন। শৈশব থেকেই নানারকম শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকেন সোফোক্লিস। ছোটবেলা থেকেই যে গ্রীকশিক্ষায় শিক্ষিত হন তিনি, তাতে সঙ্গীত এবং শিল্পও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সঙ্গীতে সোফোক্লিস খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।

গ্রীসদেশের সংস্কৃতির অধিকাংশটাই তখন প্রায় বলা যেতে পারে ডায়োনোসিয়া উৎসবের নাট্য প্রতিযোগিতায় কেন্দ্রীভূত ছিল। গ্রীসের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট অলিম্পাসে সেই খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে উক্ত উৎসবটি উপলক্ষে যে নাটকের প্রতিযোগিতা হত তা কেবলমাত্র বিনোদনের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সেই প্রতিযোগিতায় হারজিতের ওপর নাট্যকারদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান অনেকখানি নির্ভর করত। কমেডি, স্যাটায়ার ইত্যাদি বিভিন্ন রকম নাটকের চল থাকলেও সেখানে ট্র্যাজেডির কদর ছিল সবচেয়ে উঁচুতে। উচ্চমানের ট্র্যাজেডি রচয়িতাকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট নাট্যকারের সম্মান প্রদান করা হত প্রাচীন গ্রীসে। অ্যারিস্টটলও ট্র্যাজেডিকেই বিবিধ প্রকার নাটকের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু আসন প্রদান করেছিলেন। অলিম্পাস পর্বতে সেই ডায়োনোসিয়া উৎসবের নাট্য প্রতিযোগিতাকে আসলে ট্র্যাজেডি-যুদ্ধ বলা যেতে পারে। কোন নাট্যকার কত ভাল ট্র্যাজেডি রচনা করতে পারেন, এ যেন তারই লড়াই ছিল। প্রতি বছর এই প্রতিযোগিতার জন্যই প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ ট্র্যাজেডি রচিত হত। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান পেয়েছিলেন থেসপিস। পরবর্তীতে এই ট্র্যাজেডি রচনার ধারায় আরও যে তিনটি নাম জনপ্রিয় হয়েছিল, তাঁরা হলেন এস্কাইলাস, ইউরিপিডিস এবং সোফোক্লিস।

৪৬৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সোফোক্লিস তাঁর কয়েকটি নাটকের জন্য ডায়োনোসিয়া উৎসবের নাট্যপ্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেছিলেন।জানা যায় যে, মোট ২৪ বার নাট্যপ্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন সোফোক্লিস, যার মধ্যে ১৮ বার জিতেছিলেন এই ডায়োনোসিয়া উৎসবের প্রতিযোগিতাতে এবং ৬ বার জেতেন লেনিয়া উৎসবে।তাঁর রচনায় গ্রীসদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি সোফোক্লিসকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল।

প্রায় ১২৩টি নাটক সোফোক্লিস রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়, তবে তা থেকে কেবল যে সাতটি নাটক উদ্ধার করা গিয়েছিল, সেগুলি হল, ‘অ্যাজাক্স’, ‘ইডিপাস রেক্স’, ‘ইলেক্ট্রা’, ‘ইডিপাস অ্যাট কলোনাস’, ‘উওম্যান অব ট্র্যাচিস’ ‘ফিলোকটেটাস’ এবং ‘আন্তিগোনে’। এই অবলুপ্তিরও অবশ্য এক কারণ রয়েছে। গ্রীক সমাজে লেখার অনীহা ছিল। তাছাড়া একবার কোন নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেলে তা আর কোন মঞ্চে অভিনীত হওয়ার রীতি ছিল না। নাটক সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও খুব বেশি জোর দেওয়া হয়নি, ফলে অসংখ্য নাটক কালের গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে।

৪০৬ বা ৪০৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দে নব্বই বা একানব্বই বছর বয়সে শীতকালে এই বিখ্যাত গ্রীক ট্র্যাজেডি রচয়িতা সোফোক্লিসের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরেও নানান কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, শ্বাস না নিয়ে ‘আন্তিগোনে’ নাটক থেকে একটি দীর্ঘ বাক্য আবৃত্তি করবার সময় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আবার কেউ বলেন, এথেন্সের অ্যান্থেস্টেরিয়া উৎসবে আঙ্গুর খেতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তৃতীয় আরেকটি মতানুযায়ী, ডায়োনিসিয়ার উৎসবে চূড়ান্ত জয়লাভের ফলে অতিরিক্ত আনন্দের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

গ্রীক পৌরাণিক এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ইডিপাস কমপ্লেক্স শব্দটি তৈরি করেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। ইডিপাস কমপ্লেক্স মনোবিশ্লেষণের একটি ধারণা যা বিপরীত লিঙ্গের পিতামাতার প্রতি সন্তানের আকাঙ্ক্ষা এবং একই লিঙ্গের পিতামাতার সাথে একই সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বর্ণনা করে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস (1899) বইয়ে এই ধারণাটি চালু করেছিলেন ।

বিশ্বসাহিত্য বিচারে সর্বকালের সেরা ট্র্যাজেডি ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস রচিত ‘ইডিপাস’।নানাভাবে মানুষ ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারেন; নিয়তির ক্রীড়নক মানুষ। দৈবশক্তির প্রভাবে মানবজীবনে দুঃখের প্রবেশ ঘটতে পারে। গ্রিক পুরাণ মতে, মানুষ নিয়তির বাইরে একধাপও এগোতে পারেন না। মানুষের অদৃষ্টে যা লেখা রয়েছে তা যে-কোনোভাবে ঘটবেই। ‘ইডিপাস’ নাটকের কাহিনিতে সফোক্লিস সেই বিষয়টি চিত্রিত করেছেন।

‘রাজা ইডিপাস’ নাটকের মূল কাহিনী সূত্রটি নিম্নরূপ:

থিবিসের রাজা লেয়াস। জোকাস্টা তার স্ত্রী। বহুদিন সন্তান না হওয়ার কারণ জানতে রাজা লেয়াস একাকী ডেলফির মন্দিরে যান। দৈববাণী শোনা গেল যে, তার এই সন্তান না হওয়ার দুর্ভাগ্যকে তার আশীর্বাদ মনে করা উচিত। কেননা জোকাস্টার গর্ভজাত এবং তার ঔরসজাত সন্তান কালে তার হত্যাকারী হবে। সে জোকাস্টাকে কোনো কথা জানাল না, বরং সে জোকাস্টা থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগল। জোকাস্টা তাকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে সন্তানবতী হলো। নয় মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র লেয়াস ধাত্রীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মেষপালকের হাতে দিল তাকে মারার জন্য মিথায়েরন পর্বতে। নবজাতকের পা দু’টো লোহার শিক দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো যাতে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পারে।

কিন্তু বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। নিয়তির নির্দেশে নবজাতকের মৃত্যু হলো না। পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক তাকে কুড়িয়ে পেলো এবং তার নাম দিলো ইডিপাস। কেননা তার পা দু’টো পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করার ফলে ফুলে গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ইডিপাস শব্দের অর্থ পা ফোলা। মেষপালক তাকে করিনথে নিয়ে এলো। সে সময় রাজা পলিবাস করিনথে শাসন করছিলেন। রাজা পরিবাস ও রাণী মেরোপী নিঃসন্তান। তাই তারা ইডিপাসকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করতে লাগলো।

একদিন করিনথের এক যুবক ইডিপাসকে এই বলে বিদ্রুপ করলো যে, সে দেখতে তার পিতামাতার মতো নয়। ইডিপাস সন্দিগ্ধ হয়ে ডেলফির মন্দিরে গেল। দৈববাণীতে তার প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেল না, বরং বলা হলো যে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং মাতাকে বিয়ে করবে। এটা তার নিয়তি। চরম হতাশা ও মর্মের বেদনায় বেদনার্ত ইডিপাস আর করিনথে ফিরে না গিয়ে ফোসিস নামে এক জনপদের কাছাকাছি একটা তে-রাস্তার মোড়ে এলো । সে সময় এক বৃদ্ধ রাজা কয়েকজন অনুচরসহ রথে করে যাচ্ছিলেন। ইডিপাসকে রাস্তা থেকে সরে যাবার হুকুম দেয়া হলো। ইডিপাস সরে না দাঁড়ালে রাজা রথ চালাবার হুকুম দিলেন। রথের একটি চাকা ইডিপাসের পা থেঁতলে দিলো এবং রেগে গিয়ে ইডিপাস রাজা এবং তার অনুচরদের হত্যা করলো। একজন মাত্র অনুচর কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গিয়ে থিবিসে জানাল যে, রাজা অনুচরসহ নিহত হয়েছেন দস্যুদের হাতে। ইডিপাস জানতেও পারলো না যে, দৈববাণীর প্রথম অংশ তার জীবনে ঘটে গেল। অর্থাৎ সে তার পিতাকে হত্যা করলো।

রাজা লেয়াস ডেলফির মন্দিরে যাচ্ছিলেন এই জানার জন্যে যে, কী করে স্ফিংসের হাত থেকে থিবিসবাসীকে রক্ষা করা যেতে পারে। সে সময় স্ফিংসের অত্যাচারে থিবিসবাসীর জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। একাকী পথচারীকে পেলে স্ফিংস একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো এবং উত্তর দিতে না পারলে তাকে হত্যা করতো ।

লেয়াসকে হত্যার পর ইডিপাস থিবিসের দিকে যাবার পথে নগরপ্রান্তে স্ফিংসের কবলে পড়ে। ধাঁধার উত্তর ইডিপাসের জানা ছিল। ধাঁধার উত্তর শুনে স্ফিংস পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। কেননা এটা হলো তার নিয়তি।স্ফিংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে থিবিসবাসী ইডিপাসকে রাজারূপে বরণ করে নিল। ইডিপাস রাজা হয়ে দেশাচার অনুযায়ী রাজার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করলো। কারণ সে তো জানতেই পারলো না লেয়াসের বিধবা স্ত্রী তার গর্ভধারিণী মা।

এরপর সুদীর্ঘ পনেরোটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। থিবিসের প্রজারঞ্জক রাজা হিসেবে ইডিপাস পরম কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। তাই সে থিবিসবাসীর প্রিয় রাজা। পারিবারিক জীবনেও সে জোকাস্টাকে নিয়ে সুখী। তার চারটি সন্তান- দু’টি ছেলে, দু’টি মেয়ে। ইডিপাস জানতে পারেনি দৈববাণীর দ্বিতীয় অংশটিও তার জীবনে বহুপূর্বেই সফল হয়েছে। অর্থাৎ তারই গর্ভধারিণী তার শয্যাসঙ্গী হবে তা তার জীবনে নির্মমভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

এটাই হলো ‘রাজা ইডিপাস’ নাটকের পূর্বসূত্র বা কাহিনী। এরপর থিবিস রাজ্যজুড়ে নেমে এলো মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। মৃত্যুর অমানিশা। ভীত-সন্ত্রস্ত নগরবাসী এলো ইডিপাসের কাছে মুক্তির আশায়। এরপর আমরা ইডিপাসের যন্ত্রণাজর্জর জীবনের করুণ ট্র্যাজেডির স্বরূপ উদঘাটনে প্রয়াস পাবো।

রাজ্যময় মহামারী আর দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নগরবাসী ইডিপাসের কাছে এলো। ইডিপাস প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশায় কাতর। সে রাজ্যশ্যালক ক্রিয়নকে এপোলোর মন্দিরে পাঠালো দেবতার নির্দেশ জানার জন্যে। ক্রিয়ন সবার সম্মুখে দৈববাণী জানাতে ইতস্তত করতে লাগলো। কিন্তু সে ইডিপাসের কথায় বললো, রাজ্যের মধ্যে এক মহাপাপকে লালন করা হচ্ছে। এ পাপ মোচন করতে পারলে রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে।

কী সেই পাপ? ভূতপূর্ব রাজা লেয়াসকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ হত্যাকারীর শাস্তিবিধান করা হয়নি। আর হত্যাকারী এ রাজ্যেই আত্মগোপন করে আছে। দেবতার নির্দেশ তাকে নির্বাসনে দিতে হবে। ইডিপাস নগরবৃদ্ধদের ডেকে লেয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য তাদের সহযোগিতা চাইল। তারা জানালো ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসই এর সমাধান দিতে পারবে। টিরেসিয়াসের কাছে ইডিপাস লেয়াসের আততায়ীর সন্ধান জানতে চাইল। সে ইডিপাসকে সত্য কথা বলতে চাইল না। এতে ইডিপাস উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমি এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। এই অন্যায় অভিযোগ শুনে টিরেসিয়াস ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বলে ইডিপাসই রাজা লেয়াসের হত্যাকারী। শুধু তাই নয়, সে তার নিকটতম আত্মীয়ের সাথে পাপের মধ্যে বসবাস করছে। এই অবিশ্বাস্য কথা শুনে ইডিপাসের মনে সন্দেহ হলো, ভাবল হয়তো ক্রিয়ন রাজ্যের লোভে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।

এরপর ক্রিয়নের সঙ্গে ইডিপাসের বাকবিত-া শুরু হয়। কেউ শান্ত হতে চায় না। এমন সময় রাণী জোকাস্টা এসে সব কথা শুনে বলল, এতে ইডিপাসের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সত্য হয় না। যদি তাই হতো তবে আপন সন্তানের হাতে লেয়াসের মৃত্যু হতো। কিন্তু তাতো হয়নি। তিনদিনের শিশুকে নির্জনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আর সকলেই জানে ফোসিস নামে এক জনপদের কাছে তে-রাস্তার মোড়ে দস্যুদলের হাতে লেয়াসের মৃত্যু হয়েছে।

এই কথা শুনে ইডিপাস চমকে উঠলো এবং লেয়াসের মৃত্যুর ঘটনা তার অন্তরে এক অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করলো। লেয়াসের চেহারা কেমন ছিল, কয়জন লোক তার সঙ্গে ছিল। সব কিছু সে জিজ্ঞেস করে যখন মিলে গেল, তখন সে বুঝতে পারল, সে-ই লেয়াসের হত্যাকারী এবং বেঁচে যাওয়া অনুচরকে খুঁজে বের করলো বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। এমন সময় করিনথে থেকে এক বৃদ্ধ এসে খবর দিল যে, রাজা পলিবাসের মৃত্যু হয়েছে এবং সেখানকার জনগণ ইডিপাসকে রাজা হিসেবে পেতে চায়। ইডিপাস জানে, সে পলিবাসের সন্তান। পলিবাসের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অতএব দৈববাণী মিথ্যা প্রতিপন্ন হতে দেখে সে এবং জোকাস্টা আনন্দিত হয়। তবু ইডিপাসের আশঙ্কা, তার মা মেরোপী বেঁচে আছে। তাই করিনথে ফিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেনি সে।

করিনথের রাজদূত ইডিপাসের মনের শংকা দূর করতে চাইলো। সে বলল, ইডিপাস রাজা পলিবাস মেরোপীর আপন সন্তান নয়। এক মেষপালক শিশু ইডিপাসকে কুড়িয়ে পায় এবং সে নিঃসন্তান রাজা-রাণীর হাতে তাকে তুলে দেয়। তারা তাকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করে। কিন্তু তারা ইডিপাসের আপন পিতামাতা নয়। ইডিপাস মেষপালকের সন্ধানে লোক পাঠায়। এই মেষপালকের কথা জোকাস্টা ইতঃপূর্বে ইডিপাসকে বলেছে। সব ঘটনা শুনে জোকাস্টা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং ইডিপাসকে ক্ষান্ত হতে অনুরোধ করে। কিন্তু ইডিপাস কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না। সে তার জন্ম-রহস্য উদঘাটন করবেই। কিন্তু জোকাস্টার কাছে সব কিছু দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। সে অস্থির উন্মাদনা নিয়ে চলে যাবার আগে বলে গেল, ‘অন্ধ, তুমি অন্ধ। হায়রে অভাগা। তুমি যেনো কখনো না জানো তুমি কে।’ জোকাস্টা উন্মাদিনীর ন্যায় প্রাসাদ অভ্যন্তরে চলে গেল।

জোকাস্টার এরূপ ব্যবহারে ইডিপাস ভাবল হয়তো কোনো নীচু ঘরের সন্তান সে। তবু সে জন্ম-রহস্য জানার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। মেষপালক এলে দেখা গেল এই একই লোক ফোসিস থেকে পালিয়ে এসে লেয়াসের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিল। প্রথমে সে কোনো কথা বলতে চাইল না। কিন্তু ইডিপাসের শাস্তির ভয়ে সে সব কথা খুলে বলল। ইডিপাস তার জন্ম ও জীবনের নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি হয়ে এক মর্মভেদী অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে ভেসে এলো জোকাস্টার হৃদয়ছেদী নিাদরুণ আর্তচিৎকার। কিছুক্ষণ পর এক অনুচর এসে জানালো নিদারুণ লজ্জা, অপমান ও বেদনায় জোকাস্টা আত্মহত্যা করেছে। আর ইডিপাস তারই পোশাক থেকে একটি কাঁটা খুলে নিজের চক্ষু নিজেই উপড়ে ফেলেছে।

পথ হাতড়ে বেরিয়ে এলো অন্ধ ইডিপাস। নিজের শাস্তি নিজেই মাথা পেতে নিল। স্বদেশ থেকে দূরে বহুদূরে নির্বাসনই তার একমাত্র শাস্তি। বালিকা কন্যার হাত ধরে বেরিয়ে যায় হতভাগা ইডিপাস। সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এক মর্মস্পর্শী বাণী অলংঘনীয় নিয়তির নিষ্ঠুর পীড়নে জীবন-যৌবন, ধন-মানের ব্যর্থতার হাহাকারে পিষ্ট ইডিপাসের জীবনকাহিনী।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *