—— তাহা ইয়াসিন
নজরুল কয়েকটি ইনডাইরেক্ট প্রেমপত্র লিখেছিলেন ফজিলতুননেসাকে সেকারণে তাঁর নাম অনেকেই জানে। ফজিলতুননেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের মেধাবী ছাত্রীদের অন্যতম । তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল। পিতার নাম আবদুল ওয়াহেদ খান। তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদারবাড়িতে চাকরি করতেন। ফজিলতুননেসা ও তাঁর বোন শরীফুন্নেসাকে তিনি ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করান।
পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করায় ফজিলতুননেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বৃত্তি পেয়েছিলেন। সে সময় অর্থাৎ ১৯২৮ সালের দিকে তিনি গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ওই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি ভবনও আছে।
১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সন্মেলনে অতিথি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা এসেছিলেন। নজরুল তখন বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা। প্রমীলা, প্রমীলার মা গিরিবালা দেবীসহ তিনি কৃষ্ণনগরে বাস করেন। ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের সাথে কাজী মোতাহার হোসেনও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেই হিসেবে নজরুল ঢাকায় এসে ওঠেন তাঁর বাসায়। কাজী মোতাহার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও হাউজ টিউটর হিসেবে এখনকার বাংলা একাডেমির পুরাতন ভবনটি বাসা হিসেবে পেয়েছিলেন। সেটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ছিল। নজরুল ওই বাসায় রাত্রি যাপন করেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বয়সের পার্থক্য সামান্য হওয়ায় একধরণের সহজ সম্পর্ক ছিল।
কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে বিভাগের ছাত্রী ফজিলতুননেসা জানতে পেরেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম হাতের রেখা দেখে ভাগ্য গণণা করতে পারেন। ফজিলতুননেসার জীবন সম্পর্কে উচ্চাভিলাষ ছিল তাই তিনি তাঁর ভাগ্য গণনার জন্য নজরুলকে হাত দেখাতে চান। কাজী মোতাহার হোসেনই হাত দেখার ব্যবস্থা করে দেন। কাজী নজরুল ইসলামের কবি ও শিল্প প্রতিভার সাথে বিন্দুমাত্র পরিচয় তাঁর ছিল বলে কোনো গবেষকই উল্লেখ করতে পারেননি এমনকি কাজী মোতাহার হোসেনও না। নজরুলের সাথে ফজিলতুননেসার সাক্ষাত পরিচয় এটুকুই। এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে যেতে যেতে এবং পৌঁছার মাস দুয়েকের মধ্যে মোট আটটি সাহিত্যিক প্রেমপত্র লিখেছেলেন কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠির ভেতরের কথাবার্তায় আকারে ইঙ্গিতে ফজিলতুননেসার উল্লেখ রয়েছে। মাস দুয়েক পরে আর কোনো চিঠি লেখেননি। ঘটনা এখানেই সমাপ্ত। কেউ কেউ বলেছেন ফজিলতুননেসাও নজরুলকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ওই বলা অবধি ।কেউ সেই চিঠি হাজির করতে পারেননি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নজরুলের সাথে ফজিলতুননেসার প্রেম ও আরো নানা কেচ্ছাকাহিনী কেউ কেউ লিখেছেন। অনেকে রটিয়েছেন। এখনো রটানো চলছে। আরো চলবে। অনেকেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এধরণের রসালো কেচ্ছা পছন্দ করে।
ফজিলতুন্নেসা বিলেতে পড়তে যান কলকাতা হয়ে। বিলেত পড়াশোনার বৃত্তি জোগাড় করেছিলেন মোহামেডান এডুকেশনের এ. ডি. পি. ই খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর সহায়তায়। তাঁর পুত্র শামসুদ্দোহাও ফজিলতুননেসার সাথে বিলেত যান এবং পরবর্তীতে শামসুদ্দোহার সাথে ফজিলতুননেসা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ফজিলতুননেসার বিলেতযাত্রার সংবর্ধনার জন্য ‘ সওগাত ‘ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন যে আয়োজন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তিনি সদ্য স্ত্রীবিয়োগের পর কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিয়েছেন ‘ সওগাত ‘ পত্রিকায়। নিজের কথার সাথে সাথে তিনি সেই ঘটনারও যৎকিঞ্চিত বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থে
‘ আমি সওগাতে গিয়ে নাসিরুদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করলাম। দেখলাম, ‘ সাপ্তাহিক সওগাত ‘ প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। তিনি আমাকে মাসিকের সাথে সাথে সাপ্তাহিকেও কাজ করতে বললেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে ওয়াজেদ মিয়ার উদ্যোগে ‘সাপ্তাহিক সওগাত ‘ বেরুলো। আমিও সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিলাম। আরো একজনকে সম্পাদকীয় বিভাগে নেয়া হল। তিনি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। আমি ও প্রেমেন সম্পাদকীয় নোট লিখতাম। ওয়াজেদ মিয়া সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন। তিন জনে মিলে কাটিং করে সংবাদ চয়ন করতাম। শুধু আমরা নই, নজরুল ইসলামের উপরও সাপ্তাহিকের একটা বিভাগের ভার ছিল। তিনি লিখতেন অম্লমধুর ‘চানাচুর ‘। ‘সাপ্তাহিক সওগাত ‘ অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় কাগজ হয়ে উঠলো।
একদিন নাসিরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মিস ফজিলতুননেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে অংকে এম-এস সি পাশ করে বিলেত যাচ্ছেন। তিনি কলকাতা এসে ‘সওগাত’অফিসে উঠবেন। আমার মনে হয় , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলাত-যাত্রী প্রথম মুসলিম মহিলা শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁকে আমাদের তরফ থেকে একটা অভিন্দন দেয়া উচিত। আপনারা কি বলেন?
নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী তখন ‘সওগাত ‘ অফিসেই ছিলেন। আমিও ছিলাম। আমরা সকলেই একযোগে নাসিরুদ্দীন সাহেবের প্রস্তাবে সমর্থন জানালাম। স্থির হলো, এই উপলক্ষে নজরুল ইসলাম একটি গান রচনা করবেন এবং সংবর্ধনা-সভায় সে- গান স্বয়ং কবিই গাইবেন। আরো স্থির হলো, সংবর্ধনা-সভায় কয়েকজন সাহিত্যিক ও কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দাওয়াত করা হবে এবং ‘ মধুরেণ সমাপয়েতের’ জন্য তাতে কিছু জলযোগের ব্যবস্থাও থাকবে।….
পরদিন বিকেলের দিকে ‘ সওগাত ‘ অফিসেই সংবর্ধনা-বৈঠক বসল। আগের দিন রাতেই মিস ফজিলতুননেসা ‘সওগাত ‘ অফিসে পৌঁছেছিলেন। সভায় কয়েকজন বক্তা মিস ফজিলতুননেসার কৃতিত্বের প্রশংসা করলেন এবং বিলাতযাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম মহিলা-শিক্ষার্থিণীর সাফল্য কামনা করলেন। মিস ফজিলতুন্নেসা তাঁকে এ -সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানালেন। নজরুল ইসলাম এই উপলক্ষে স্বরচিত সঙ্গীত গাইলেন।…
নজরুলের এ সময়োপযোগী গান ও দরাজ কন্ঠ উপস্থিত সকলকে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখল। তারপর চা-মিষ্টিতে অনুষ্ঠানের মধুর সমাপ্তি হল। ‘
নজরুলের জীবনে সেসময় প্রচন্ড আর্থিক সংকট নেমে আসে । এর অল্পকিছুকাল আগে তিনি প্রাদেশিক নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কোনো আয়ই তখন ছিল না। সেকারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টের মাঝে নাসিরুদ্দীনের ‘সওগাত’ পত্রিকায় ৫/৬ টি শর্তে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন । যে শর্তেই হোক তাঁর কিছু উপার্জন করা তখন অনিবার্য ছিল। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, চাকরির কাজ হিসেবেই সকলে এই সংবর্ধনায় যোগদান করেছিলেন। এখনকার কোনো পত্রিকা অফিস কিংবা টিভি চ্যানেল এরকম একটি সংবর্ধনার আয়োজন কেন করে থাকে তা গভীরভাবে ভাবলে যে কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারবে।
পরোক্ষ এই প্রেমপত্রগুলোর কয়েকটি সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে ‘দিলরুবা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন । পরবর্তীতে পুস্তকারে বের করেন ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ নামে আটটি চিঠি । তারপর ‘স্মৃতিপটে নজরুল’ নামক এক প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন ফজিলতুননেসার সাথে নজরুলের দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কিছু কথা লিখে বিষয়টিকে ধোঁয়াশা করে তোলেন। সেই থেকে এই বিষয়টি নজরুল জীবনের সাথে কালিমালিপ্ত হয়ে থাকে। তিনি লেখেন, ‘ নজরুল ইসলাম কিছু কিছু জ্যোতিষী জানেন ,এবং হস্তরেখা দেখে ভাগ্যগণনা করতে পারেন, আমার কাছ থেকে এ-কথা শুনে ফজিলত নজরুলের কাছে হাত দেখাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।… বর্ধমান হাউসে আমার ভাইবোনসহ অনেক লোক থাকায় ,আমিও বাইরের ছোট ঘরটায় নজরুলের সঙ্গেই এক বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতাম। একদিন প্রাতে উঠে দেখি নজরুল বিছানায় নেই। ব্যাপার কি? পরে অনেক বেলাতে জানা গেল কখন যেন তিনি আলগোছে উঠে চলে গিয়েছিলেন দেওয়ান বাজার রাস্তার উপর অবস্থিত ফজিলতের গৃহে। ‘ এরপর আরো যেসব কথা তিনি লিখেছেন সেগুলো নজরুলকে মহিমান্বিত করেনি এবং ফজিলতুননেসা যে তাঁর স্নেহভাজন ছাত্রী ছিলেন সেটা ভাবতেও মনে খটকা লাগে। নজরুল চিরতরে নির্বাক ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলার পর ফজিলতুননেসাকে উদ্দেশ্য করে কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের ইনডাইরেক্ট প্রেমপত্রের বিষয়টি দূষিতভাবে উপরোক্ত দু’জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মাধ্যমে প্রচারিত হয়। চিঠিগুলো রচনাবলীতে আছে আগ্রহীরা পড়ে দেখলেও বুঝতে পারবেন এই প্রেমের কেচ্ছার মাঝে আসলে কি ছিল।