জীবনের উদ্দেশ্য কী

জীবনের উদ্দেশ্য কী

Share

শাহিনুল ইসলাম খান শান্ত
————– —–
পৃথিবীতে জন্ম মাত্রই এক অনিবার্য সত্যের মুখোমুখি হতে হয় প্রত্যেক মানুষকে, ‘ মৃত্যু ‘- সেই অনিবার্য সত্য । হোক আস্তিক , হোক নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদী- গন্তব্যের অবসান মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই ঘটে । তর্ক – বিতর্ক , ভালো- মন্দ, সত্য – অসত্য, বিশ্বাস- অবিশ্বাস সকল থিওরির মিলন ঘটে এই মৃত্যু নামক মহাসমারোহে।

মানুষ আসে , মানুষ যায় ; রেখে যায় শুধু জীবনের ছাপ। রক্তপিন্ড থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চলার পথে মানুষের সঙ্গে ” শিক্ষা ” নামক এক অদ্ভুত বিষয়ের সাক্ষাৎ ঘটে বারংবার। মানুষ প্রতিনিয়তই শিখে, আর এই ধরণীই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষাঙ্গন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটা পদক্ষেপে আমরা শিখে যাই। শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরু। জীবনের এই অধ্যয়ন পর্বে কখনো শিক্ষক, কখনো মাতা , কখনো দেশমাতা, কখনো প্রকৃতি আমাদের গুরু হয়ে সামনে আসে ; আর যেখানে গুরুর উপস্থিতি সেখানে গুরুদক্ষিণার প্রসঙ্গও চলে আসে।

আজ একবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে এসেও আমরা সুসভ্য হতে পারিনি। অধর্ম -অরাজকতা ছেয়ে আছে আমাদের চারপাশ জুড়ে। মানুষে মানুষে এতো বিদ্বেষ, স্বার্থ হাসিলের জন্য এত শঠতা! মাঝে মাঝে মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে যেন আদিম যুগে ফিরে এলাম। আদিমতাকে গ্রহণ করে টিকে থাকার নামে স্বার্থ হাসিলের খেলায় আজ আমরা মগ্ন। নিজ স্বার্থ রক্ষাতে কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করে আমরা আজ যে অসুস্থ্য মানসিকতায় পর্যবসিত হয়েছি তার চেয়েও ভয়াবহ রোগে আমরা আক্রান্ত – ‘অপরের ক্ষতিসাধনে পৈশাচিক আনন্দ’ । দেশের ও দশের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের অসাড়তা বার বার আমাদেরকে পরাজিত করে চলেছে। হত্যা,ঘুম,খুন,লুণ্ঠন,শঠতা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সুযোগের অভাবে যে কয়জন স্বভাবজাত লোকের সন্ধান মেলে সুযোগ পেয়ে তারাও ছুটে অধর্মের পিছে। এর কারণ হয়তোবা গুরুদক্ষিণা সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব।

একলব্য,গুরুদক্ষিণার প্রবাদপুরুষ। নিষাদরাজ হিরন্যধনুর পুত্র একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করতে এসে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মনের দুঃখে গুরু দ্রোণাচার্যের মাটির মূর্তি নির্মাণ করে ধনুর্বিদ্যা চর্চা করতে লাগলেন। গুরুভক্তি ও অধ্যবসায়ে সে সেরা অস্ত্রকুশলী ও ধনুর্ধারী হয়ে উঠল।কিন্তু অর্জুন! যাকে দ্রোণাচার্য আশীর্বাদ করেছিলেন, “তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ শিষ্য আমার আর হবে না।” অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন, ” যথার্থই যদি আমার শিষ্য হও তবে আমার গুরুদক্ষিণা দাও” যা ছিল একলব্যের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল! ফলে একলব্যের তীর নিক্ষেপের ক্ষমতা হ্রাস পায় ও অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।গুরুর প্রতি এই ভক্তির নমুনা স্বরূপ একলব্য হয়ে গেলেন গুরুদক্ষিণার অপর নাম।

সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তো আমরাই, আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ হয়ে যেহেতু এসেছি এর একমাত্র গুরুদক্ষিণা তো মানবসেবাই বা মনুষ্য ধর্মের পূজাই। তবে কেন এ কথা বুঝেও মানতে চাই না আমরা। সুযোগ পেলেই কেন অপরের ক্ষতি করিতে এক পা বাড়িয়ে দিতে হবে? মানবধর্মের সম্ভাব্য ক্ষতি আন্দাজ করলেই সেখান হতে দুই পা পিছিয়ে আসাই তো অধর্ম ঠেকানোর একমাত্র পথ। আর যেথায় মানবের জয়গান সেথায় দুই পা এগিয়ে দিলেই ধর্ম রক্ষা। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে যে গৌরব লাভ করেছি তার গুরদক্ষিণা যে এক আনাও দিতে পারিনি আমরা। আর সে জন্যই হয়তো এমন হেডলাইনও দেখতে হয় “মাদ্রাসার ছাত্র ও হুজুররা পাহারা দিচ্ছে মন্দির।” পাহারা কেন দিতে হবে! মানুষ হয়ে অপর মানুষের দুঃখের কারণ না হতে পারার মাঝেই তো মানবধর্ম রক্ষা। মানবধর্ম রক্ষা করো ,মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছো তাই অত্যাবশ্যকীয় গুরুদক্ষিণা দাও, তবেই আর পাহারা দেয়ার কথা ভাবতে হবে না।

একটা শিশু জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজেই বেড়ে উঠে। চলার পথে সমাজও আমাদেরকে পদে পদে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সমাজের প্রতি ও আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। সেইসব দায়িত্ব ও কর্তব্য পূরণ করার মাধ্যমেই সমাজের প্রতি আমাদের গুরিদক্ষিণা সম্পন্ন হয়। কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদাগুলো পূরণ করতে যেয়ে আমরা আজ এতোটাই আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছি যে সে কথা ভুলেই গেছি। এই সমাজে আমরা একা নই, কেবল আমাদের পরিবার নয়; এর বাইরে এমন শত-সহস্র মানুষ রয়েছে, যারা আমাদের অজান্তে আমাদের জীবনে অজস্র অবদান রেখে যাচ্ছে, যাদেরকে আমরা চিনি না , যাদের ঋণ আমরা কখনই সরাসরি শোধ করতে পারি না। কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্যে আমাদের যে দায়িত্ব তার কতটুক পালন করতে পারছি?

যদিও বঙ্গদেশ তার কোমলতা দিন দিন হারাচ্ছে (কারণ অনুসন্ধান করলেই মিলবে আমাদের কর্মকাণ্ড) তবুও সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই মাটির সংস্পর্শে এসে যে প্রাণ জুড়িয়েছি এরও তো গুরুদক্ষিনা পাওনা আছে। তবে কেন দেশের ক্ষতি করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে যেতে পারি আমরা! যা মায়ের ছত্রছায়ায় আমাদের স্থান সেই মাকেই হরণ করে ঘুমেই বা আসে কি করে ? বিজ্ঞজন বলে গেছেন ব্যক্তি সমাজের আত্মাস্বরুপ, আর আমাদের আত্মারই আজ পচন ধরেছে। তাই দেশের ক্ষতির চেয়ে নিজের লাভের দিকেই আমাদের অধিক মনোযোগ। দেশ উচ্ছন্নে যাক, দেশের মানুষ উচ্ছন্নে যাক , নিজের সুখ প্রতিষ্ঠা পেলেই হলো। কিন্তু মুর্খ হৃদয় জানেনা, এ যে সুখ নয়, পরম দুর্ভোগ। আত্ম কে শুদ্ধ করলেই এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আত্মা তথা নিজে ঠিক থাকলে দেহ তথা সমাজও ঠিক থাকবে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *