যে কবিতার জন্য নজরুল জেল খেটেছিলেন

তাহা ইয়াসিন

বিশ শতকের বিশের দশকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবোত্তর পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক পটভূমিকায় সাহিত্যিক হিসেবে নজরুলের আত্মপ্রকাশ। এ সময় তাঁর কাব্যপ্রতিভা অভিব্যক্ত হয়েছিল বহুমুখী ধারায়, বিচিত্রভাবে, স্বকীয়তায় সম্পন্ন ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত রূপে। তাঁর কাব্যক্ষমতা ও শিল্পশৈলী রসোত্তীর্ণ হয়ে যে সামাজিক কার্যকারিতা সৃষ্টি করেছিল, তা তাঁকে বাঙালীর হৃদয়ে প্রথম সারির কবিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ভারতবর্ষে যখন দীর্ঘ দিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার কলধ্বনি, ইতিহাসে এই প্রথম যখন সমগ্র বাঙালি জেগে উঠেছে, ঠিক তখনই নজরুল বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্তের উন্মোচন করলেন। সহায়-সম্বলহীন পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা, যুদ্ধ ফেরত তরুণ কবির কণ্ঠে মানুষের যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত দুঃখ-বেদনা ও কান্না-মিশ্রিত ক্ষোভ অসাধারণ বিক্রমে উদগীরিত হয়েছে।

নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নে ১৯২২ সালে ‘ব্যথার দান’, ‘অগ্নি-বীণা’ ও ‘যুগবাণী’ গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে তিনি ঘোষণা করলেন ‘চির-উন্নত মম শির’। এর মাধ্যমে বিদেশী-বিভাষী শাসিত কুব্জ হয়ে যাওয়া বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। একইভাবে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটির ‘নবযুগ’, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!’ ‘ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’, ‘লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলকাতার দৃশ্য’ এবং ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রভৃতি প্রবন্ধেও তিনি জাগরণী চিন্তাধারার উদ্রেক ঘটান। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই ২৩ নভেম্বর ১৯২২ এটি নিষিদ্ধ হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হয়নি। এরপর ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। এই কবিতার জন্য নজরুল এক বছর জেল খাটেন। সাহিত্য যে শোষক-নির্যাতনকারীর গায়ে চাবুকের মতো আঘাত করতে পারে তারই উদাহরণ নজরুলের এই কবিতা। এটি তাঁরই সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ১২শ সংখ্যায় (১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুতে প্রকাশের পর এটি তাঁর সুস্থাবস্থায় কোনো গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়নি।কবিতাটি প্রকাশের পর পুলিশ ধূমকেতু অফিসে হানা দেয় ৮ নভেম্বর ১৯২২ সালে। পুলিশ নজরুলকে খোঁজ করে কারণ তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী দন্ডবিধি আইনের ১২৪-ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। ‘ধূমকেতু’ অফিসে তখন উপস্থিত ছিলেন মুজফফর আহমদ ও আবদুল হালিম। তাঁরা পুলিশকে জানান, নজরুল কলকাতার বাইরে। কবিতাটি প্রকাশের ছয় সপ্তাহ পর ৮ নভেম্বর নজরুলের গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ পুনরায় ‘ধূমকেতু’ অফিসে এবং প্রেসে হানা দেয়। পুলিশ ৩২, কলেজ স্ট্রীটে হানা দিয়ে ‘ধূমকেতুর’ প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফজালুল হককে গ্রেফতার করে। তিনি অবশ্য তিন-চার দিন প্রেসিডেন্সি জেলে হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তিলাভ করেন। পুলিশী হামলা সত্ত্বেও ধূমকেতু ২২শ সংখ্যা ১৭ নভেম্বর ১৯২২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এরপরের ‘ধূমকেতু’র কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশক ও মুদ্রাকর অমরেশ কাঞ্জিলালের পরিচালনায় প্রকাশিত হয়। রফিকুল ইসলাম জানান, ‘নজরুলের গ্রেফতারের পূর্বেই বিহারে সমস্তিপুরে চলে যান, গিরিবালা দেবী তখন প্রমীলাকে নিয়ে সেখানে ভাইদের কাছে ছিলেন। নজরুল সমস্তিপুর থেকে তাদের নিয়ে কুমিল্লায় যান।’কুমিল্লা ‘ঝাউতলা মোড়’ থেকে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক রাত রেখে পরদিন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যায় পুলিশ। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে নজরুলকে রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়।

নজরুলের পক্ষ সমর্থনে বেশ ক’জন আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মলিন মুখোপাধ্যায়। মামলার অপর আসামী এবং জামিনে মুক্ত নজরুলের বন্ধু ধূমকেতুর প্রকাশক আফজালুল হক নজরুলের বিপক্ষে সরকারী ‘এপরুভার’ হয়ে সাক্ষ্য দেন। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মতান্তরে ১৭ জানুয়ারি বিচারক সুইনহো মামলার রায় দেন। ভারতীয় ফৌজদারী দন্ডবিধির ১২৪-ক এবং ১৫৩-ক ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন।বিচারক সুইনহো একজন কবি ছিলেন। বিচারক একজন কবি হয়েও নজরুলকে সাধারণ কয়েদীর পর্যায়ে ফেলেন। প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত করেননি। সে সময় তিনি আদালতে যে জবানবন্দী দেন সেটিও তাঁর এক অনন্য সৃষ্টি। ১৯২৩ সালে ধূমকেতুতেই তা ছাপা হয়। জবানবন্দীটি ‘রাজবন্দির জবানবন্দী’ নামে খ্যাত। এটি নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলেই লিখেছিলেন। বিচারপতি যে একজন কবি নজরুল তা জানতেন। তাই জবানবন্দিতে বলেছেন,’শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট। কিন্তু বেলাশেষের শেষ খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্তঊষার নবশঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা করছে; তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন; তাই আমাদের উভয়ের অস্ততারা আর উদয় তারার মিলন হবে কিনা বলতে পারি না। …আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো- একি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়ত সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী? এ ক্রন্দন কি একা আমার? না-এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল-নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের ঐ প্রলয়-হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আত্মার যন্ত্রণা-চিৎকার। আমায় ভয় দেখিয়ে মেরে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না। হঠাৎ কখন আমার কণ্ঠের এই হারাবাণীই তাদের আরেকজনের কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে।আজ ভারত পরাধীন না হয়ে যদি ইংল্যান্ড ভারতের অধীন হতো এবং নিরস্ত্রীকৃত উৎপীড়িত ইংল্যান্ড অধিবাসীবৃন্দ স্বীয় জন্মভূমি উদ্ধার করবার জন্য বর্তমান ভারতবাসীর মতো অধীর হয়ে উঠত, আর ঠিক সেই সময় আমি হতুম এমনি বিচারক এবং আমার মতই রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত হয়ে এই বিচারক আমার সম্মুখে বিচারার্থ নীত হতেন, তাহলে সে সময় এই বিচারক আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলতেন, আমিও তাই এবং তেমনি করেই বলছি।’

নজরুলের এই জবানবন্দীতে যে জ্বালাময়ী প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ছিল কবিতাটির মাঝে। আর নজরুল তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে তীব্র প্রতিবাদের জোয়ার তুলেছিলেন, তাই তাঁকে জেলে পুরে দমাতে চেয়েছিল ইংরেজ সরকার। নজরুলের পূর্বে ইংরেজের রাজরোষে পড়েছিলেন বেশ ক’জন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁদের মধ্যে মুকন্দদাস (১৮৭৮_১৯৩৪), সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯-১৯২২) অন্যতম। কিন্তু নজরুলকে নিয়ে দেশজুড়ে যে আন্দোলন-বিক্ষোভ হয়েছে। অন্যদের বেলায় হয়নি। কারণ পূর্বের ওই সকল সাহিত্যিকের চেয়ে নজরুলের প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল বেশি শক্তিশালী এবং নজরুল ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় কবি। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে নজরুলকে গ্রেফতারের পর রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি ১৯২৩ তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়।

কেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির ওপর ইংরেজের খড়গহস্ত প্রসারিত হয়েছিল? ইংরেজ সরকারের পক্ষে এই কবিতা সংবলিত ধূমকেতু বাজেয়াপ্ত না করে উপায় ছিল না। এর কারণ কবিতাটির মর্মার্থ সকালীন অসহযোগ উত্তর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের জয়গান এবং সমালোচনা। কবিতাটিতে এ আন্দোলনকে সক্রিয় করার জন্য সমস্ত দেশবাসীর প্রতি ছিল অগ্নিময় আহ্বান। অন্যদিকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ-উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যাঁরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের লড়াইয়ের কথা । সিরাজউদ্দৌলা, মীরকাসিম, টিপু সুলতান, ঝাঁসির রানী, রানী ভবানী, এই সকল দেশপ্রেমিক বীর-বীরাঙ্গণার আত্মত্যাগের প্রসঙ্গ এতে উল্লেখিত হয়েছে। এ ছাড়াও এতে সমকালীন রাজনৈতিক নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ক্ষোভ, মহাত্না গান্ধী, অরবিন্দ ঘোষ,চিত্তরঞ্জন দাশ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বারীণ ঘোষ প্রমুখের নিষ্ক্রিয়তায় ব্যঙ্গ; এবং ধর্মের নামে ভন্ডামি ও অহিংসার নামে কাপুরুষতার প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। তাই স্বভাবতই ডাক পড়েছে মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গার। তিনি লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ অর্থাৎ ধন, বিদ্যা সিদ্ধিদাতা দেবতাকে দূরে রেখে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দুর্গাকে ভারতবর্ষের রণক্ষেত্রে কবিতাটিতে আগমনের আহ্বান জানিয়েছেন।ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের এ কবিতায় তিনি দেবশিশু, দেবসেনা, গান্ধীকে বিষ্ণু, তাঁর চরকাকে বিষ্ণুর চক্র; বিপ্লবববাদী বারীণ ঘোষকে মহেশ্বর; দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে ব্রহ্মা আখ্যা দিয়ে পৌরাণিক রূপকের আড়ালে স্বাদেশিক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রতিটি চরণের আড়ালে রয়েছে সমসাময়িক ঘটনার চিত্র। এ কবিতাটির নির্বাচিত কিছু পঙক্তি বিশ্লেষণ করলে সমসাময়িক সমাজের উল্লেখিত চিত্র পাওয়া যায়।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম

দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে, রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে ? উদ্ধৃতিটিতে দেব-সেনা বলতে তিনি চিহ্নিত করেছেন বিপ্লববাদী রাজনীতিকদের যারা ইংরেজ শাসকদের চোখে সন্ত্রাসবাদী। এঁরা এখন তেপান্তরের দ্বীপান্তরে জেলের অন্তরালে ইংরেজের ঘানি টানছে। দ্বীপান্তর মানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজশক্তির দ্বীপান্তরী কারাগারে। দেবসেনা দ্বীপান্তরে কারাবন্দী হওয়ায় দেবীকেই রণাঙ্গনে আসতে বলেছেন তিনি। দেবী না এলে অসুর শক্তির (ব্রিটিশের) বিরুদ্ধে কে লড়বে? বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয়-বছরি ফন্দি-কারায়, চক্র তাহার চরকা বুঝি ভন্ড হাতে শক্তি হারায়! এখানে বলা হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর (১৮৬৯-১৯৪৮) কথা। তাঁকে নজরুল বিষ্ণু প্রতীকে উপস্থাপন করেছেন। অসহযোগ আন্দোলন সহিংস রূপ পরিগ্রহ করার লক্ষণ দেখেই গান্ধীজী হঠাৎ এই আন্দোলন বন্ধ ঘোষণা করেন। এই সুযোগ গ্রহণ করে ভারতের ব্রিটিশ সরকার। তারা গান্ধীকে আটক করে এবং ছয় বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করে। নজরুল গান্ধীর এই বন্দিত্ববরণকেও চিত্রিত করেছেন অদূরদর্শী রাজনৈতিক কাজ হিসেবে। মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে, অরবিন্দ চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে সে জানে! এখানে তুলে ধরা হয়েছে রাজনীতিক অরবিন্দ ঘোষকে (১৮৭২-১৯৫০) যিনি এখন ধ্যানমগ্ন হয়েছেন পন্ডিচেরির আশ্রমে। অথচ তাঁর স্বদেশী আন্দোলনের ডাকে সারা বাংলার তরুণ সমাজ রুদ্ররূপে স্পর্ধিতভাবে জীবনদানে উন্মুখ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’ জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। বছরের পর বছর জেলে নির্যাতিত হয়ে অবশেষে সব কিছু ত্যাগ করে পন্ডিচেরিতে অন্য এক জীবনে চলে যান। তাঁর এ ধ্যানমগ্ন মৌনতায় নজরুল আক্ষেপ করেন। সদ্য অসুর-গ্রাসচ্যুত ব্রহ্মা-চিত্তরঞ্জনে, হায় কমন্ডুলের শান্তি বারী সিঞ্চি যেন চাঁদ নদীয়ায়। এখানে বলা হয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) কথা। যিনি ইংরেজের কারাগার থেকে সবে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি এখানে ব্রহ্মার প্রতীকে উপস্থাপিত। সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন দানব-রাজার অত্যাচারে, দম্ভ তাঁহার দম্ভোলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে। এখানে তুলে ধরা হয়েছে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে (১৮৫৮-১৯২৫) যিনি ইংরেজের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন। তিনি দানব রাজা অর্থাৎ ইংরেজ সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন বিদ্রোহী দমনের। তিনি মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তাঁর মানবতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি। মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে ভারতবাসীর স্বপ্নসাধ তিনি ধূলিসাৎ করার মন্ত্রণা দিচ্ছেন। রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে। এ অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) উপস্থাপিত হয়েছেন। রবির আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লেও পরাধীন ভারতের জনজীবনের মধ্যে সেই আলো পড়েনি। অন্ধ কারার ভেতরে সেই আলো পৌঁছেনি। এতে প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের বেদনামিশ্রিত ক্ষোভ। বারি-ইন্দ্র বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায় বুড়িগঙ্গার পুলিন বুকে বাঁধছে ঘাঁটি দস্যু-রাজায়। এখানে তুলে ধরা হয়েছে অরবিন্দের ছোট ভাই ‘বোমারু বারীন্দা’ নামে সারা ভারতে খ্যাত বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে (১৮৮০-১৯৫৯)। নজরুল অগ্নিযুগের এই অগ্নিপুরুষকেই অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। দ্বীপান্তরের কারাভোগের পর এই বিপ্লবী নেতা ‘নিরালা’ জীবন যাপন করছেন। আর ঢাকার পুলিন বিহারী দাসের (১৮৭৭-১৯৪৯) বুকেও যেন দস্যু রাজা বাসা বেঁধেছে। এই ইঙ্গিতই এখানে দিয়েছেন। আজ দানবের রং মহলে তেত্রিশ কোটি খোজা গোলাম লাথি খায় আর চ্যাঁচায় শুধু, ‘দোহায় হুজুর, মলাম মলাম।’ এখানে তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীকে বীর্যহীন খোজা গোলামের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এরা নপুংসক, তাই প্রতিবাদ এদের চরিত্রে নেই। অথবা এদেরকে নপুংসকে পরিণত করা হয়েছে, যাতে শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে। মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা-বোল নাকি-নাকি, খাঁড়ায় কেটে কর্ মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি! এখানে প্রকাশিত হয়েছে গান্ধীর অহিংস-নীতির প্রতি ব্যঙ্গ শ্লেষ। অহিংসাবাদী গান্ধী-অনুসারীদের ‘মাদী’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন নজরুল । ওই সকল নপুংসকের দেশপ্রেমের ফাঁকি খড়গে কেটে বিনাশ করতে দেবীকে আহ্বান করেছেন তিনি। লক্ষ্মী-সরস্বতীকে তোর আয় মা রেখে কমল-বনে বুদ্ধি-বুড়ো সিদ্ধিদাতা গণেশ-টনেশ চাইনা রণে। এ অংশে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে নজরুল কমল বনে রেখে আসতে বলেছেন। আর বলেছেন গণেশের প্রয়োজন নেই রণাঙ্গনে। বৃথাই গেলো সিরাজ, টিপু, মির কাসিমের প্রাণ-বলিদান চন্ডী ! নিলি যোগমায়া-রূপ, বলল সবাই বিধির বিধান। এখানে ভারত ইতিহাসের বীরপুরুষদের অবদানের কথা বলা হয়েছে। সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩০-১৭৫৮), টিপু সুলতান (রাজত্বকাল ১৭৮২-১৭৯৯), মির কাসিমের আত্ম-বলীদানের (মৃত্যু ১৭৭৭) পরে যে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভারতবাসীর জীবনে নেমে এসেছিল, তা ভাঙার জন্য একদিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করে। ঝাঁসীর রাণীও (মৃত্যু ১৮৫৮) ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে লড়তে লড়তে জীবন দান করেন। এই আত্মবলীদান, কি বৃথা যাবে? নজরুলের ক্ষোভ এই জন্য যে, এসব ঐতিহাসিক ঘটনাধারার জাগ্রত স্মৃতি সত্ত্বেও দেবী মাটির মূর্তি ভেঙে সশরীরে আবির্ভূত হচ্ছে না। অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষুসী তোর যায়নি ক্ষুধা; আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা! এখানে তিনি দেবীকে বলেছেন অনেক পাঁঠা মোষ খেয়েছিস শতাব্দীকাল ধরে, এবার তোর সন্তানের রক্তপান করার জন্য আয়। তবু তুই মৃন্ময়ীরূপ ‘ভেঙে’ সত্য হয়ে জেগে ওঠ, আর তখনই তোর সত্যিকারের আগমনী বাজনা বেজে উঠবে এবং সেই জাগরণী বোধন বাজনায় উন্মাতাল হয়ে শামিল হবে ভারতবাসী।

কারাদন্ড হওয়ার আগেই রাজরোষে নজরুলের বই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। কিন্তু জেলে যেতে হয় তাঁকে সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা এই কবিতাটির জন্য। বিচারাধীন থাকার সময় নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাখা হয়। কারাদন্ডের পর তাঁকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ জেলে নজরুল ছিলেন প্রায় তিন মাস, ১৭ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল ১৯২৩। এ প্রসঙ্গে মানিক মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘চির উন্নত শির’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘নৈহাটি স্টেশনে গাড়ি এলে তাঁকে সাধারণ পোশাক পরানো হল-ডোরাকাটা প্যান্ট শার্ট। কোমরে বাঁধা হল দড়ি। নজরুলের মনে কোনো কষ্ট ছিল না। ছিল না কোনো বেদনার ছাপ। জেলের কয়েদিরা বিদ্রোহী কবিকে পেয়ে খুশি।’জেলের নৈরাশ্যপূর্ণ পীড়াদায়ক পরিবেশের মধ্যে নজরুল তাঁর গান ও আবৃত্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের মনে আনন্দ ও আশার সঞ্চার করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে জেলের কয়েদীদের সাথে নজরুলের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আর সাথে সাথে কয়েদিদের ওপর নির্যাতনও বাড়তে থাকে। নজরুলের হাতে লোহার হাতকড়া, পায়ে বেড়ি পরিয়ে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়া হল। তিনি লোহার গরাদের সঙ্গে ঘা দিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে গাইতে লাগলেন শিকল পরার গান। ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ কিংবা আবৃত্তি করতে থাকলেন ‘সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়’ ইত্যাদি। ফলে জেলের অবস্থা ক্রমে ঘোরালো হয়ে উঠল এবং যত রকম শাস্তি দেয়া যায় তার সব ব্যবস্থা করা হল। কয়েদীদের ওপর অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে নজরুলসহ অন্য কয়েদীরা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।প্রথম প্রথম ধর্মঘটের খবর যাতে বাইরে না যায় তার জন্য নানা রকম চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরে তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রায় দু’সপ্তাহ পরে ২৮ এপ্রিল ১৯২৩ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘২১ জন বন্দির অবস্থা শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কাজী নজরুল ইসলাম, মৌলবি সিরাজউদ্দিন এবং গোপাল বাবু যথাক্রমে ১৪, ১২ এবং ১৩ দিন যাবৎ সম্পূর্ণ অনাহারে। কাজী নজরুলের রাত্রিতে ভয়ানক জ্বর হয় এবং মাথায় রক্ত উঠিয়া অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছে। জ্বরের সময় তিনি অজ্ঞান হইয়া পড়েন’। মে মাসের ১২ এবং ২২ তারিখের সংবাদ থেকে আরো জানা যায়, ‘কবিকে জোর করে নাকের ভিতর দিয়ে নলের সাহায্যে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষের সে চেষ্টা সফল হয়নি।’এ সময় শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অনশনের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হন। সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রাম পাঠান, ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ তবে সে তারবার্তা শিলঙে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত যায়। এরপর রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আবারও চিঠি লিখেছিলেন নজরুলের সংবাদ নেয়ার জন্য। জেলে অনশন চলাকালে ১৭ মে (১৯২৩) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পত্র লিখে কানপুরে শ্রীমতি লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে জানান, হুগলি জেলে আমাদের কবি নজরুল ইসলাম উপোস করিয়া মর মর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়িতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখি না। একজন সত্যিকারের কবি, রবিবাবু ছাড়া বোধ হয় এখন আর এত বড় কবি নাই। উল্লেখ্য যে, শরৎচন্দ্র জেলে গিয়ে দেখা করতে পারেননি। ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে নজরুলের সমর্থনে এক প্রতিবাদ সভারও আহ্বান করা হয়। ঐ সভায় রাজবন্দীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নির্মমতার কথা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হয়। ঊনচল্লিশতম দিনে নজরুলের মাতৃসম বিরজাসুন্দরী দেবী কুমিল্লা থেকে গিয়ে অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন (২৩ মে ১৯২৩)। জেলে থাকাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সদ্য প্রকাশিত নাটক ‘বসন্ত’ নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন,’নজরুল কারাবরণ করে সমগ্র দেশবাসীর যে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ এটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। তিনি উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, উৎসর্গ, শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু, ১০ ফাল্গুন ১৩২৯। ‘বসন্ত’ গ্রন্থটি নজরুলকে আলিপুর জেলে পৌঁছে দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকো ডেকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ সেখানে ভক্তজন পরিবৃত হয়ে বসেছিলেন। পবিত্র বাবুকে তিনি বললেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’… … রবীন্দ্রনাথ একখানা ‘বসন্ত’ -এ নিজের নাম দস্তখত করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তাকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’ সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার বিস্মিত হয়েছিলেন, টেগোর ঐ প্রিজনারকে বই ডেডিকেট করেছেন বলে। নজরুল ‘বসন্ত” বইটি তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঐ উৎসর্গ নজরুলের জেল জীবনের বেদনার অনেকটা উপশম করতে পেরেছিল। নজরুল এ সম্পর্কে পরে লিখেছেন, এ সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত ” নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর আশীর্বাদ মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে যাই। নজরুল আরো লিখেছেন,হে সুন্দর, বহ্নি দগ্ধ মোর বুকে তাইদিয়ে ছিলে ‘বসন্তের ” পুষ্প মালিকা।

১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলী জেলে স্থানান্তর করা হয়। এই জেলে নজরুলের সহবন্দীদের মধ্যে কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমদ, বরিশালের সতীন্দ্রনাথ সেন এবং কবি খান মোহাম্মদ মইনুদ্দীন ছিলেন। জেলের সুপার বন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে নজরুল তাকে নিয়েও প্যারোডি লেখেন ‘সুপার (জেলের) বন্দনা’। নজরুলের জেলের সঙ্গী নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবতী ‘নজরুলের সঙ্গে কারাগারে’ (১৯৭০) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই বন্দিশালার সীমাবদ্ধ ও শাসন সংযত পরিবেশেও কত সহজেই না কাজী গান লিখতেন, সুরারোপ করতেন, লিখতেন দীর্ঘ কবিতা। জেলের মধ্যেই ‘বালেশ্বর বলিদান’ দিবস পালন করা হয়। সেখানে কাজী ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি গেয়েছেন। এই গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। সভাপতির ভাষণ শেষ হল। কিন্তু সভা ভঙ্গ হল না। নজরুল নতুন করে সভা শুরু করে জাঁকিয়ে ধরলেন গান। স্বরচিত গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গান। নজরুল বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে। তাঁর বন্দী জীবন সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, ‘কারাগারে আমরা অনেকে যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায় যে, তিনি একজন জ্যান্ত মানুষ।’ সাহিত্য যে সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সেটাই ছিল নজরুলের জীবনবোধ। তাঁর চিন্তাধারা ছিল জীবনের সমস্ত অধিকার হারিয়ে জীবন ধারণ করার চেয়ে জীবন দিয়ে জীবন প্রতিষ্ঠা করাই মহত্তর। আর সে জন্যই তাঁকে জেল খাটতে হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *