কবি সমুদ্র গুপ্ত —– আদিত্য নবী

কবিরা যোগান শ্লোগানের ভাষা, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দ্রোহের শক্তি এবং সাহস। কবিরা তাদের কবিতার চেতনার দ্বারা মানুষের অধিকারবোধকে জাগ্রত করেন। কবিতা মানুষের চেতনার অংশ হয়ে মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। কবিতা যেন হয়ে ওঠে মানুষের নিত্যদিনের সমস্ত অধিকারবোধের সচেতনতা। যেমন,
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে ; মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ; এ বিশ্বের যা – কিছু মহান সৃষ্টি চির- কল্যাণকর , অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর ; বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর ; এই মৃত্যু উপাতাক্যা আমার দেশ নয় ; সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে ; এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ট্র সময়।

বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক মঞ্চের কুশিলবদের জন্য তেমনই এক অমোঘ সত্য লিখে গেছেন সমুদ্র গুপ্ত,
‘ নাপতার পোলা কাপতান হলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুরি কাঁচি । ‘

যুগে যুগে যে কোন অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী কবিতা। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে শাসকশ্রেণী সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কবিতাকে। কারণ কবিতা দিকে দিকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। সিকান্দার আবু জাফরের সেই কবিতা, ‘ তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া, তুমি বাংলা ছাড়ো ; পাকিস্তানি সেনারা কবিকে সেদিন হন্যে হয়ে খুঁজেছে। একুশের উত্তপ্ত কবিতাও কি কম উদ্দীপনাপূর্ণ? কবি এবং কবিতা একই রকম শক্তিসম্পন্ন। কবিতা কবির চেতনাজাত সৃষ্টি। তাই কবি এবং কবিতা একই গতিতে চলে। কবিতা কবির জীবন সংশয় ঘটায় কিন্তু কবি তার জন্য পরোয়া করেন না। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়েই চলেন কবিরা। আমরা কবিতার কাছে আরো বেশি ঋণি, কারণ ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ দুটোতেই কবিতা মাঠের সৈনিকদের দিয়েছিল অমিত শক্তি। কবিরা কবিত্ব ছাড়া আর কারো কাছে করজোড়ে হাঁটু গেড়ে বসেন না।

মানুষের ভেতর থেকে উঠে এসে মানুষের মুখের ভাষা, মানুষের চেতনার কথাকে কবিতায় রূপান্তরিত করে গেছেন কবি সমুদ্র গুপ্ত। যাঁকে অনেকেই আমরা চিনি না। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কবি। মারা যান ১৯ জুলাই ২০০৮ সালে। তাই তাঁকে স্মরণ করা। তাঁকে যারা দেখেছেন তারা সবাই জানেন জীবন ছিল তাঁর কাছে পালকের ন্যায় হালকা। অভাব-অনটন ছিল কিন্তু শ্বেতশুভ্র দীর্ঘ গোঁফ ছিল হাসিতে ঝলমল। তাঁর সাথে দেখা হলে নিজেকে অনেক হালকা মনে হতো। জীবনের এত স্ফুর্তি সাথে ছিল তাঁর। দিনের যেকোন সময় দেখা হলেও তাঁর প্রাণ ছিল তরতাজা।

সমুদ্র গুপ্তের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ জুন সিরাজগঞ্জে। থাকতেন পশ্চিম ধানমন্ডির ছোট্ট এক ভাড়া বাসায়। তাঁর দুই মেয়ে এবং স্ত্রী সে বাসায় থাকতো। আমি অনেকবার ওই বাসায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য এক প্রকাশনার প্রুফ দিতে এবং আনতে। ভালো প্রুফ দেখতে পারতেন। সেটা করে সামান্য আয় হতো। প্রুফ দেয়ার সময় আমার মালিক কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলতেন, ‘ এটা দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে বলবেন। বাকী টাকা কাজ শেষ হলেই দিয়ে প্রুফ নিয়ে আসবেন। এটা বললে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করবে। অভাবী মানুষ। টাকা সব আগে দিলে কাজটা শেষ করবে না। ‘ আমি কথাগুলো শুনতাম চুপ থেকে, হজম করতে ভীষণ কষ্ট হতো। একজন কবি যাঁকে শ্রদ্ধা করি তাঁর প্রতি একজন মালিকের এরকম আচরণ সহ্য করা আমার জন্য সেসময় অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। তবুও করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটা ছিল আমার জীবনের প্রথম বেতনভুক্ত চাকরী। তাই। এরকম মালিকশ্রেণি ঢাকা শহরের পথে-ঘাটে বহু আছে এবং যুগে যুগে থাকবে । মালিকশ্রেণি কিংবা কোনো ধনিলোকের নাম কেউ কোনো বইয়ে লিখে রাখে না । এসব শ্রোতের শ্যাওলারা মানুষকে যতেষ্ট যন্ত্রণা দেয় কিন্তু একজন আহমদ ছফা কিংবা একজন সমুদ্র গুপ্তের করুণাও পায় না । কাল প্রবাহে কবি সমুদ্র গুপ্তরা জন্মে এবং মানুষের মাঝে টিকে থাকে নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই ।

একজন বড়মাপের মানুষ না হলে বড় কবিও হওয়া যায় না, কথাটা খ্রীস্টপূর্ব সাড়ে চারশত বছর আগের। বলেছিলেন গ্রীসের কবি হোরেস। হোরেসের আর্স পোয়েটিকা বা হোরেসের কাব্যতত্ত্ব যারা পড়েছেন তারা তা জানেন। সমুদ্র গুপ্তই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে একমাত্র বড় কবি ছিলেন সেটা বলা হচ্ছে না। তবে তিনি কবিতাই লিখেছেন। কবিতা লেখেন এই ক্ষমতা দেখিয়ে কারো কাছে কিছু চাইতে যাননি। তাঁর কাঁধে সবসময় একটা ঝোলা থাকতো। সেটাতে করে আয়ুর্বেদীয় ঔষধও বেচতেন। খুব কষ্টে ঢাকা শহরে টিকে ছিলেন। কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারা সকলেই তা জানেন। বছর খানেক পর আমি ওই চাকরি ছেড়ে দেই। এরপর তাঁর মৃত্যু অবধি একটা সম্পর্ক ছিল। আজিজে প্রায়ই দেখা হতো। মাথাভর্তি ধবধবে চুল, বড় গোঁফ -যেন প্রাচীন ভারতের ঋষিপুরুষ।

অসাধারণ রস ও রসিকতা ছিল তাঁর কথায়। খুব যে কথা বলতেন তাও নয়। শ্রোতার প্রশ্নের যতটুকু উত্তর তাই দিতেন। প্রায়ই আজিজে আসতেন আড্ডা দিতেন। সমুদ্র গুপ্তও নেই সেই আজিজ মার্কেটও নেই, এখন আজিজ হয়েছে শপিংমল। তখন প্রায়ই দোকানই ছিল বইয়ের।
তাঁর পারিবারিক নাম ছিল আবদুল মান্নান বাদশা। সমুদ্র গুপ্ত তাঁর বানানো নাম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ” সমুদ্র গুপ্ত ” ছদ্ম নামে কবিতা, গল্প,প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম লিখতেন। কর্মজীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ছিলেন, প্রেসের কর্মচারী, করাতকলের (ছ’মিল) ম্যানেজার, জুটমিলের বদলী শ্রমিক, এনজিও কর্মি, ওষুধ বিক্রেতা, প্রুফ রিডার, সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক ও সর্বোপরি কবি। তাঁর জীবনও একটি কবিতা। অদম্য উদ্যোমে জীবনকে বয়ে চলেছেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : ‘রোদ ঝলসানো মুখ’, ‘স্বপ্নমঙ্গল কাব্য’, ‘এখনো উত্থান আছে’, ‘চোখে চোখ রাখে’, ‘একাকী রৌদ্রের দিকে’, ‘শেকড়ের শোকে’, ‘ঘাসপাতার ছুরি’, ‘সাত সমুদ্র নদীও বাড়িতে ফেরে’, ‘ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেই পথ’, ‘চলো এবার গাছে উঠি’, ‘হাতে হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়’, ‘তাহলে উঠে দাঁড়াব না কেন’, ‘খালি হয়ে গেছে মাথা শুধু ওড়ে’।

প্রবন্ধগ্রন্থ : ডিসেম্বরের রচনা। সম্পাদনা গ্রন্থ : বাংলাদেশে বঙ্কিম অন্যান্য।

বাংলাদেশের শোষিত মানুষের জীবনচিত্র কত নির্মমভাবে উঠে এসেছে এই কবিতাগুলোতে,

‘বড়লোক গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মানুষ আর
মানুষের সরল জীবন এটাই নিয়ম’
[কুকুর, সাত সমুদ্র, পৃষ্ঠা-১১]।

‘আমার স্বপ্ন এখন প্রচণ্ড রক্তপাতের
অশান্ত অস্থির দু’বাহুতে পৃথিবীরে পিষ্ট করে
ভেঙে চুরে তছনছ করে দেয়ার একটি মিছিল চাই’
[আমার স্বপ্ন এখন, সাত সমুদ্র ১৯]।

‘সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে বাইরে বেরোলাম
পিঠে ঝোলার মধ্যে যুদ্ধকালীন শৃঙ্খলার নোট
কবিতার বই, প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি এবং
লক্ষ্যভেদের যাবতীয় সরঞ্জাম’
[রণকৌশল, সাত-সমুদ্র পৃষ্ঠা-২২]।

‘ক্ষমতা ফুলের গন্ধের লোভে কতো মাছি হলো মৌমাছি
ঘোড়ার ডিমের ব্যবসা ধরেছে,
মেডেলের মালা গলায় পরেছে
নাপতার পোলা কাপতান হলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুরি কাঁচি।’

কবিতা সমাজের কথা বলে ; বলে মানুষের জীবন নিংড়ানো দুঃখের কথা। আমাদের চারপাশের দুঃখগুলো কবিরা শব্দ দিয়ে মালা গাঁথেন কবিতায়। এর সাথে জীবনের সুখ, প্রেমানুভূতির প্রকাশও থাকে। একেবারে মানুষের কোলাহলের ভেতর যতরকম অনুভূতি আছে তার প্রায় সবটাই কবির মগজে গেঁথে যায়। কবিতা হয়ে সেগুলো আমাদের কাছে আসে ; আমরা তাই পড়ে হাসি কিংবা কাঁদি। কবিরা মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যান না, মানুষের মাঝে থেকেই কবি হয়ে ওঠেন। সমুদ্র গুপ্ত সেভাবেই কবি হয়ে উঠেছিলেন। জীবন ঘষে কবিতা লিখে গেছেন। কবিত্ব হারিয়ে তিনি পাবলিক হয়ে যাননি। সেজন্যই তাঁর জন্য মনটা কাঁদে। এমন একজন নিরেট কবিকে কাছ থেকে আর দেখা হবে কিনা তাও জানিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *