ওরিয়ানা ফাল্লাচির হাত বাড়িয়ে দাও ——- তাহা ইয়াসিন

একজন মা তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানটির জন্য কত রকমের স্বপ্ন দেখে তাঁরই লিখিতরূপ ওরিয়ানা ফাল্লাচির হাত বাড়িয়ে দাও বইটি। ১৯৮২ সালে বাংলা ভাষায় এটির অনুবাদ করেন আনু মুহাম্মদ।তাঁর অনুবাদটি অনেকেরই পড়া আছে ।
ওরিয়ানা ফাল্লাচি ১৯২৯ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহন করেন। পেশাগত জীবনে ছিলেন সাংবাদিক। সেকারণে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ পনেরো বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ২০০৬ সালে সাতাত্তর বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে ডাক্তার যখন তাঁর মৃত্যুর পুর্বাভাস দিয়েছিল তখনও তিনি বলেছিলেন, ‘ আমি জীবনের কথা শুনতে চাই ডক্টর, মরণের কথা নয়। ‘
জীবনকে সবার মতো তিনিও প্রচন্ড ভালোবাসতেন । ওরিয়ানা ফাল্লাচির পিতা এডোরাডো ফাল্লাচিকে মুসোলিনীর সেনাসদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে । হত্যার কথা থাকলে তাকে হত্যা না করে কারান্তরালে শাস্তি দেয় । পিতার জন্য এমন উৎকন্ঠা নিয়ে বড় হয়েছেন ওরিয়ানা ফাল্লাচি । একারণে শ্বাপদসংকুল এই প্রথিবীতে তিনি নিজে কিভাবে আরেকটি সন্তানের জন্ম দেবেন?
তাই দেখা যায় মাতৃত্বের বার্তা যতটা না তাঁকে সুখী করে তার চেয়ে বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তাঁর জরায়ুতে বড় হতে থাকা মানবভ্রুণটিকে নিয়ে। তিনি চিন্তা করেন তাঁর শিশুটিকে এই জরাগ্রস্ত, নির্মম, হানাহানিপূর্ণ, বিশ্বাসঘাতকে পূর্ণ পৃথিবীতে আনা উচিত কিনা ? এই শঙ্কা নিয়ে গ্রন্থের শুরু,
‘ গত রাতেই প্রথম টের পেলাম তুমি আছ – অসীম এক শূন্যতা থেকে আসা একটি ছোট জীবনবিন্দুর মতো। তোমার অস্তিত্বের এই আকস্মিক ঘোষণা আমাকে অভিভূত করল, বিস্মিত করল এবং বিদ্ধ করল একটি বুলেটের মতো।এক অজানা ভীতি আমার সারা শরীরে, সমগ্র সত্তায়। অন্যদের জন্যে এই ভয় নয়-আমি কাউকে পাত্তা দেই না।…
ভয় তোমার জন্যে। যেখানে এবং যেভাবে আসছ তার জন্যে তোমাকে স্বাগত জানানোর আগ্রহ আমার কোনোকালে্ই‌ ছিল না। কিন্তু জানতাম যে একদিন-না-একদিন তুমি আসবেই। আমার ভয়, যদি কোনোদিন তুমি চিৎকার করে প্রশ্ন করো- কেন তুমি আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে? কেন? কে বলেছিল তোমাকে?
জীবন সম্পর্কে এখনও তুমি কিছুই জানো না। এটি একটি যুদ্ধ, প্রতিদিনের – প্রতিমুহূর্তের। প্রতি বিন্দু আনন্দের জন্যে এখানে জীবনকে কঠোর মুল্য দিতে হয়। কী করে জানব – কোনটা তোমার জন্যে ভালো? তুমি এখনও পুরো জীবন নও, কয়েকটি জীবনকোষের সমষ্টি, সম্ভাবনা মাত্র। ‘

অনাগত সন্তানটির সাথে অবলীলায় কথা বলে যায় একজন মা। সন্তানকে যেমন সন্মোহনী শক্তি দ্বারা মা অনেক কথা, অনেক গল্প শোনায় ঠিক সেভাবে ওরিয়ানা ফাল্লাচি সন্তানকে নিয়ে তাঁর হ্রদয়াবেগের উদগীরণ ঘটিয়েছেন বইটিতে। প্রতিটি মানুষই তো মায়ের সেই উৎকন্ঠা -অনিশ্চয়তা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। জন্মের পর সেই বুড়ো শিশুরা পৃথিবীকে আরেকজন অনাগতের জন্য অনিশ্চয়তায় পূর্ণ করে তুলেছে। সেটাই ওরিয়ানা ফাল্লাচি পাঠককে জানিয়েছেন। উত্তম-পুরুষের জবানীতে লেখা এই কাহিনীর সাথে তাঁর নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে পরে প্রতীয়মান হয়েছে।

একজন মা কীভাবে ঠেলে দিতে পারে তার সন্তানকে এই নষ্ট পৃথিবীতে ? তাই তিনি চাইছেন না তার সন্তান আসুক এই রাহুগ্রস্ত পৃথিবীতে। আবার সাথে সাথেই এক অপরাধবোধে ভুগছেন। ভাবছেন এই পৃথিবীতে অন্ততপক্ষে হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করার অধিকার তো এই সদ্য পরিপূর্ণ হতে থাকা ভ্রুণটিরও আছে তাহলে কেন তাকে ভেতরে ভেতরেই শেষ করে দেবো ! এই দো’টানায় পড়ে তাঁর মন।
প্রতিদিন একটু একটু করে পরিপূর্ণ হতে থাকা ভ্রুণটির সাথে কথা বলে সমাজ-সংসার এবং সেখানে রাজত্ব করা আর শোষিত হওয়া মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিনি ‘চিন্তার সঙ্গী’ বানিয়েছেন সেই ভ্রুণটাকে এবং জিজ্ঞেস করছেন তার চিন্তার সঙ্গীকে,
‘তুমি কি হবে- ছেলে নাকি মেয়ে ?’
তারপর একটু একটু করে ব্যাখ্যা করে, মেয়ে হলে কী কী শোষণ, বঞ্চনা, নির্মমতা আর অবহেলার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তিনি এইটাও চাচ্ছেন যাতে সে মেয়ে হয়, আর তাঁর মত করে সবকিছুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে, যেভাবে এগিয়েছেন তিনি নিজে। নারী মহীয়সী, নারীর জীবন অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ এটাই তিনি মনে করেন।
তিনি পুরুষ এবং নারীর মধ্যেকার বৈষম্যকে কটাক্ষ করে বলেন,
র্পৌরাণিক উপাখ্যান বলে – জীবন ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রথম পুরুষই সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম মানব হচ্ছে একজন পুরুষ- অ্যাডাম। ইভ এসেছে পরে- তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে এবং সমস্যা সৃষ্টির জন্যে। গির্জায় যে চিত্র ঝুঁলানো থাকে সেখানেও ঈশ্বর একজন শাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ-কখনোই শ্বেতশুভ্র চুলশোভিত বৃদ্ধা নয়। এবং উপাখ্যানের সব নায়কই হচ্ছে পুরুষ- আগুনের আবিষ্কারক প্রমিথিউস থেকে শুরু করে যাকে আমরা ঈশ্বরের পুত্র বলি সেই যিশু পর্যন্ত। ‘
ওরিয়ানা ফাল্লাচি তাঁর সন্তানটি ছেলে হলে পৃথিবীতে কেমন থাকবে সে সম্পর্কে আরো বলেন,
‘ যদি তুমি ছেলে হয়ে জন্মাও তবুও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। তবে তোমার ঝামেলা তাতে অনেক কম হবে। অন্ধকার রাস্তায় ধর্ষিতা হবার ভয় থাকবে না। প্রয়োজন হবে না বুদ্ধিবৃত্তি ঢেকে মসৃণ শরীর বানানোর। নিজের পছন্দমতো কারো সাথে শুলে কোনো বাজে কথা শুনতে হবে না তোমার। মানুষ কখনোই বলবে না, যেদিন তুমি একটি নিষিদ্ধ ফল তুলে নিয়েছ সেদিন থেকেই তোমার মধ্যে পাপ ঢুকেছে। জীবন সংগ্রাম হয়তো অনেক সহজতর হবে। তুমি তখন প্রয়োজনীয় অবাধ্যতার জন্য অপমানের শিকার হবে না, ভালোবাসার ‘দায়’ হিসেবে গর্ভধারণের ভয় থাকবে না।’

কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মালেই যে সব অনাচার, অবিচার আর দায়িত্বকে থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তিনি সে সম্পর্কেও নিঃসন্দিহান নন। বরং ছেলে হয়ে জন্মালেই দায়িত্বের বোঝাটা বড্ড ভারী হওয়ার কথাই তিনি বলেন। কিছু অতিরিক্ত দায়িত্বও তখন যোগ হয়। তিনি ‘পুরুষ’ শব্দটাকে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে–
‘একজন পুরুষ মানে সম্মুখভাগে লেজবিশিষ্ট একটি মানুষ নয়-একজন পুরুষ মানে একজন ব্যক্তি। ”
ব্যক্তি শব্দটিকে তিনি এই কারণেই ব্যবহার করেছেন কারণ ব্যক্তি শব্দটিতে কোন পুরুষ বা নারীর ভেদাভেদ নেই। সুতরাং পুরুষ মানে একটা সত্তাকেই প্রাধান্য দিতে চাচ্ছেন। কোন লিঙ্গান্তরের মারপ্যাঁচে ফেলতে চাচ্ছেন না। ভীতি নামক ঘৃণ্য বিশেষণকে ঝেড়ে ফেলে দিতে বলছেন কারণ ‘এই ভীতি মানুষকে মানুষ হতে দেয় না, কুরে কুরে খায়। ‘
তাঁর ভালবাসার মানুষটি অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠা ভ্রুণটিকে নষ্ট করে ফেলতে বলে। যা কিছুতেই তিনি করেননি। তারচেয়ে বরং বয়ে নিয়ে গেছেন। বসের চোখ রাঙানি , বন্ধুর টিপ্পনী আর সামাজের মানুষের কানাঘুষা উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখেন অনাগত সন্তানটিকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর। শুরু হয় তার সমাজ-সংস্কার, রীতি-নীতি আর বাস্তবতার বিরুদ্ধে নিঃশব্দ যুদ্ধের। ভালবাসার মানুষটির এমন কদর্য রূপ দেখার পর ‘ভালবাসা’ জিনিসটা যে কি সেটা নিয়েও তাঁর মনে সন্দেহের দাঁনা বাধতে থাকে,
‘আমি এখনও বুঝি না ভালোবাসা কী? এখন মনে হয় এটি একটি বড় ধরণের তামাশা, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে, অশান্ত পৃথিবীতে তাকে শান্ত রাখার জন্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। সর্বত্র শুনি ভালোবাসার কথা-ধর্ম, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য, রাজনীতি কোথাও বাদ নেই। প্রত্যেকেই সব দুঃখের সর্বরোগের ওষুধ হিসেবে ভালোবাসাকে দাঁড় করিয়ে মানুষের দেহ এবং আত্মা উভয়ের সঙ্গেই প্রতারণা করছে। আমি এই শব্দকেই এখন ঘৃণা করি। ‘
ডাক্তার যখন বলছেন- ‘কংগ্রাচুলেশনস ম্যাডাম ‘ তখন তিনি প্রত্যুত্তরে বলছেন- ‘ না, মিস ‘। মানে উনি বিবাহিত নন। সাথে সাথেই ডাক্তারের হাস্যোজ্বল মুখটা চুপসে যায় আর শেষপর্যন্ত সকল আনুষ্ঠানিকতা বাক্সবন্দী করে ফেলে। এমনকি ‘গুডবাই’ বলার প্রয়োজনটা পর্যন্ত বোধ করে না যেন আপদটা গেলেই বাঁচে।
তারপর তিনি একে একে তিনটি গল্প শুনান যার সাথে তাঁর অবহেলিত ও বঞ্চিত জীবন প্রবলভাবে সম্পর্কিত। যার ফলে তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, ফুল ছিঁড়লেই মানুষ মারা যায়। আর চকোলেটের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে আমৃত্যু এবং বুঝতে শুরু করে যে তার প্রত্যাশিত আগামীকাল শুধুই স্বপ্ন। তাই তিনি প্রশ্ন করছেন-
‘তুমি কি ফুলগাছের মাথায় মৃত নারীদেহ দেখতে রাজি আছ? যাদের প্রয়োজন নেই তাদের উপর চকোলেটের ঢল দেখতে রাজি আছ? অন্যের নোংরা আন্ডারওয়্যার ধুতে রাজি আছ? এবং প্রতিবার উপলব্ধি করতে রাজি আছ যে, তোমার প্রত্যাশিত আগামীকাল শুধুই স্বপ্ন? ‘
সেই ভ্রুণটি কি আদৌ মুখ দেখেছিল ভোরের সূর্য আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের? সে কি কোন পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কোনদিন? সে কি কখনো জ্যোৎস্না-ধারায় মাতাল হয়েছিল? সে কি কখনো উন্মাদ নৃত্য করেছিল বর্ষার বারিধারায়?

বইয়ের শেষ লাইনগুলো থেকে এ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন,’ ঐ তো সেই ম্যগনোলিয়া গাছ। চল আমরা ফুল তুলি। কোনোদিন পারিনি এটা! তুমি পারবে?
তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।
কিন্তু তুমি কোথায়? স্বচ্ছ এক কাচের পাত্রে। তুমি নারী কিংবা পুরুষ কিছুই হতে পারলে না। কিংবা আমি হতে দিলাম না।
… জীবন তবুও টিকে থাকে। জীবন -কী সজীব কী উদ্দাম এক শব্দ। সব ক্লান্তি মুছে যায়,সব দুঃখ ঝরে যায়। অনেক আলো, অনেক কষ্ট। কে যেন দৌড়াচ্ছে। হাজার, লক্ষ,কোটি শিশু যেন চারদিকে। নতুন মানুষ সব।
আর আমাদের এখানে প্রয়োজন নেই। তুমি মরে গেছ,আমিও বোধ হয় মরে যাচ্ছি। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায় না। জীবন ধারাবাহিক। জীবনের কখনো মৃত্যু নেই। ‘
এক অবিবাহিত কর্মজীবী মায়ের দৈনন্দিন কাজের চাপ এবং বিশ্রামের অভাবে অতিরিক্ত রক্তপাতে হাসপাতালের বেডে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সারা পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যে ওলোট-পালোট হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *