আমেরিকার যুগান্তকারী সংগীত শিল্পী পিট সিগার

তাহা ইয়াসিন

সারা দুনিয়ার মানুষের বুকে প্রত্যয় জেগে ওঠে যুগান্তকারী গীতিকার পিট সিগারের গানে । অসংখ্য গান সৃষ্টি করেছেন তিনি ।তিনি ছিলেন দুর্দান্ত যন্ত্রবাদকও। তাঁর হাতে গিটার, বাঁশী,ব্যাঞ্জো বায়ুর মতো সাবলীল সুরে ঝংকৃত হতো। গান, সুর আর গীটার তাঁর জীবনকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে নিয়ে বেড়িয়েছে। জীবন যে কত সহজ, সাবলীল, অনুপ্রেরণাদায়ক, আনন্দের তা পিট সিগার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন। বিশ শতকের প্রতিবাদী চরিত্রের অগ্রপথিক তিনি। আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন শোষণের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে।

ষাটের দশেকের আমেরিকাজুড়ে চলা ‘সিভিল রাইটস আন্দোলনে’র অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি। মার্কিন সরকারের জনবিদ্বেষী, হঠকারী নীতি এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে,প্রতিবাদী মানুষের পক্ষে ছিলেন পিট সিগার। এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা সরকারের ভূমিকার বিপক্ষে আমেরিকার জনগণকে প্রতিবাদের ভাষা দেন তিনি । যুদ্ধের বিপক্ষে মানুষকে সচেতন করতে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। ম্যানহাটনের স্কুলের বারান্দায়, নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তার ধারে, সর্বত্রই তার সুর ঝড় তোলে । বারুদের বিরুদ্ধে ব্যাঞ্জোর মূর্ছনা, অশান্তির বিরুদ্ধে ভালোবাসার স্লোগান তোলেন তিনি।

পিট সিগার

পিট সিগার ১৯১৯ সালের ৩ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন শহরের এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি সুরের আবহেই বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতা চার্লস সিগার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত শেখাতেন, আর মা কনস্ট্যান্ট সিগার একজন দক্ষ বেহালাবাদক ছিলেন। তিনি জুয়েলিয়ার্ড স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বেহালা বাজানো শেখাতেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে পিট সিগার ছিলেন সবার ছোট। তার বড় ভাই মাইক ছিলেন নিউ লস্ট সিটি র‌্যাম্বলারস গানের দলের সদস্য, আর বোন পেগি ছিলেন একজন লোকসঙ্গীত শিল্পী।

ছোটবেলা থেকেই পিট সিগার প্রতিভাধর ছিলেন, পড়াশোনায় ছিলেন বেশ মনোযোগী। পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র হিসেবে অ্যভন ওল্ড ফার্মসে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দুই বছর পর পড়াশোনার গন্ডির মধ্যে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। পড়াশোনা শিকেয় উঠলো। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে স্কলারশিপ হারান। পড়াশোনার ইতি টানেন এখানেই।

এরপর আমেরিকার লোকসঙ্গীতকে বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী ধারায় পরিচিত করান তিনি। গান গাইয়ে হিসেবে তিনি বিখ্যাত নন এবং হতেও চাননি, যেকোন অস্ত্রের চেয়ে গান যে শক্তিশালী সেটি তিনি প্রমান করেন। তাঁর গানের প্রতিটি শব্দ,বাক্যে ছিল মেহনতী মানুষের জীবনগাঁথা। বাসে, রাস্তার মোড়ে, পার্কে ঢং ঢং করে বেজে উঠতো তাঁর ব্যঞ্জো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ সে সুর এবং স্পষ্ট গানের কলি শুনতো। নিজের অজান্তে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো মানুষ হারিয়ে যেতো কোনো এক সংগ্রামের মাঝে, কারো চোখ গড়িয়ে পড়তো দুফোঁটা অশ্রুবিন্দু, কারো চোখ চকচক করে উঠতো প্রতিবাদের সুরে। গান মানুষের চেতনালোক কিভাবে নাড়িয়ে দেয় তা পিট সিগারের গান শুনলে যে কোন ব্যক্তি অনুভব করতে পারবেন। একজন শিল্পী নিজের জাতি এবং সংস্কৃতির কত শত বছরের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত থাকে তার উদাহরণ পিট সিগার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *